পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে নামটা ওঠার পরপরই জানা গিয়েছিল ‘যোগাযোগ’টা। এ বার কলকাতা পুলিশের পেশ করা নথিতেও ‘যোগাযোগ’-এর বিষয়টা কবুল করে নেওয়া হল! গত তিন বছর দশ মাস ধরে পুলিশের নাগালের বাইরে থাকা পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত মহম্মদ কাদের খান ঘটনার পর পালিয়ে বেড়ানোর সময়েও তার সঙ্গেই ছিলেন শাসক দলের অতি-ঘনিষ্ঠ টালিগঞ্জের এক পরিচিত নায়িকা। শুক্রবার নগর দায়রা আদালতের বিচারক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের রায়েও পুলিশের এই তথ্যপ্রমাণটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু এটুকুই নয়। প্রায় একই সঙ্গে কাদের খানের এখনও ধরা না-পড়ার পিছনে প্রশাসন তথা রাজ্য সরকারের প্রভাবশালী অংশের ভূমিকা রয়েছে বলে তোপ দেগেছেন খোদ সরকারি আইনজীবী সর্বাণী রায়। তাঁর ধারণা, রাজ্য সরকার চাইলে এখনও কাদেরকে ধরে আনতে পারে। শুক্রবার পার্ক স্ট্রিট-মামলার রায় ঘোষণার সময়ে আদালতে সর্বাণীদেবীর ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। মামলার বিশেষ সরকারি আইনজীবী সর্বাণী কেন দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা চাইলেন না, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী তাঁকে সরকারি আইনজীবীদের প্যানেল থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথাও জানান। এর পরেই ক্ষুব্ধ সর্বাণীদেবী এ দিন উল্টে প্রশাসন তথা সরকারকেই কার্যত কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন! তাঁর কথায়, ‘‘মূল অভিযুক্ত কাদের এখনও ফেরার। সে ধরা না-পড়ার পিছনে কেউ কেউ আছে। তারা কারা, তা আমি বলব না। আমি কারও নাম করব না। আপনারা যা বোঝার, বুঝে নিন।’’ একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘সরকারের এখনও কাদেরকে ধরার ক্ষমতা রয়েছে।’’
স্বয়ং সরকারি আইনজীবীর এই মন্তব্যে কাদের খানের অন্তর্ধান-রহস্য নিয়ে প্রশাসনের অন্দরেই নয়া জল্পনা শুরু হয়েছে। লালবাজারের অফিসারদের একটা অংশের দাবি, শাসক দলের অতি-ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রীর সঙ্গে সম্পর্ককে ঢাল করেই কাদের এখনও নিজের পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এ কথা বলছেন পুলিশের ওই কর্তারা?
পুলিশের চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত বাজেয়াপ্ত তথ্যপ্রমাণের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি (ধর্ষণের ১৫ দিন পরে। তখনও তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা) মুম্বইয়ের জুহু তারা রোডের ‘ফোর সিজনস হোটেল’-এর কিছু নথি রয়েছে। হোটেলের ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে পাওয়া হোটেলের ‘রেজিস্ট্রেশন ফর্ম’-এর ফোটোকপি বলছে, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত কাদের খান সে সময়ে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ টালিগঞ্জের ওই নায়িকার সঙ্গে ওখানেই ছিল। নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে সেই হোটেলে হানা দিয়েও কাদেরকে ধরতে না-পারার জন্য এখনও হাত কামড়ান লালবাজারের গোয়েন্দারা। জনৈক অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা পৌঁছনোর ঠিক ১০ মিনিট আগে কাদের ওখান থেকে পালিয়েছিল! কী করে তার কাছে খবর গেল, সেটাই রহস্য।’’ সরকারি আইনজীবী সর্বাণীদেবীরও ঠিক এখানেই খটকা।
প্রশ্ন উঠছে, তবে কি প্রশাসনের উপর মহলের কারও কারও সহযোগিতার জোরেই মুম্বই থেকে পালিয়ে পার পেয়েছিল কাদের? যার পর থেকে তার টিকিও ছোঁয়া যায়নি!
প্রশাসনের একাংশের মত, কাদের এবং প্রশাসনের মধ্যে সেতুর কাজটা করেছিলেন টালিগঞ্জের ওই অভিনেত্রীই। জনপ্রিয় ওই নায়িকার সঙ্গে যে শাসক দলের একাধিক শীর্ষ স্তরের নেতা-মন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, তা রাজ্যের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় সবারই জানা। গত বছর নভেম্বরে সারদা-কাণ্ডে তৃণমূল নেতাদের ধরপাকড়ের প্রতিবাদে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মিছিলেও সামনের সারিতেই দেখা গিয়েছিল ওই নায়িকাকে। এ ছাড়াও ভোটের সময় শাসক দলের হয়ে প্রচারেও তাঁকে বহু বারই দেখা গিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনের অন্দরে অনেকেই বলছেন, ওই অভিনেত্রীর অনুরোধেই শাসক দলের একেবারে শীর্ষ স্তরের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই কাদেরের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। যাকে কাজে লাগিয়েই ওই অভিযুক্ত আজও অধরা।
কাদের খানের অন্তর্ধান-প্রসঙ্গে যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা, সেই নায়িকা অবশ্য বিষয়টি নিয়ে কথা ওঠায় যথেষ্ট বিরক্ত। শনিবার ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘কেন আমায় অহেতুক বিরক্ত করছেন? আপনারা কখনওই আমায় এ-বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারেন না।’’
নায়িকা যা-ই বলুন, কাদের-অন্তর্ধান নিয়ে পুলিশ যে তথ্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করেছে, তাতেই তো বলা হয়েছে মুম্বইয়ের হোটেলে তাঁর ও কাদেরের এক সঙ্গে থাকার নথি! আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশই তো তা আদালতে পেশ করেছে। লালবাজারের এক প্রবীণ অফিসারের কথায়, ‘‘পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের ঠিক পরেই কাদেরের বিষয়ে প্রশাসনের একাংশের মনোভাব অন্য রকম ছিল। গোড়ায় কী ঘটেছে, কারা কী করেছে, তা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীও পুরোটাই ‘সাজানো ঘটনা’-বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন! ফলে প্রশাসন ও শাসক দলের অন্দরে তার ছাপ পড়েছিল।’’
এত দিন বাদে ওই ধর্ষণ-কাণ্ডের রায়ে অভিযুক্তেরা আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীরা সুর পাল্টে ফেলেছেন। কিন্তু এখনও মূল অভিযুক্ত কাদেরকে ধরতে তাঁর প্রশাসনের ভূমিকা সদর্থক নয় বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন এই মামলার সরকারি আইনজীবী স্বয়ং।
তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতাও ঠারেঠোরে এই অভিযোগ মেনে নিচ্ছেন! তাঁর কথায়, ‘‘পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের তদন্তে শাসক দলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘টালিগঞ্জ ফ্যাক্টর’-এর ছায়া পড়েছে। কাদেরের সঙ্গে টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ রয়েছে। আর রাজনীতির স্বার্থেই শাসক দলের দায় আছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার। এই টানাপড়েনেই হয়তো কাদের ছাড় পেয়েছে।’’
তৃণমূল সূত্রের খবর, পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের পরে কাদের-ঘনিষ্ঠ ওই অভিনেত্রীর মানসিক অবস্থা দেখে শাসক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা-মন্ত্রীরাও অনেকেই তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। কাদেরের নাম ধর্ষণে অভিযুক্ত হিসেবে উঠে আসার পরে ওই অভিনেত্রী প্রথমটা তা বিশ্বাসই করেননি।
ঘটনাটি জানার পরে শাসক দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এক নেতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাছে ওই নায়িকা কাদেরের হয়ে দরবারও করেন। শাসক দলের আরও অনেকের কাছেই তিনি বিষয়টা জানিয়ে ছিলেন। শাসক দলের একটি অংশ জানাচ্ছেন, ওই শীর্ষস্থানীয় নেতা-মন্ত্রীদের মদতেই পুলিশকে এড়িয়ে ওই নায়িকা কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগও রেখেছিলেন।
লালবাজারের ভিতরের একটি অংশের দাবি, এই সব দিকগুলির প্রভাব পড়েছে পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের তদন্তে। দময়ন্তী সেনকে সরিয়ে দেওয়ার পরে একটা পর্যায়ে কাদেরকে ধরতে পুলিশ সে-ভাবে গা-ঝাড়াও দেয়নি। আবার এমনও হয়েছে, নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে কাদেরকে ধরতে তদন্তকারীরা সঠিক জায়গায় পৌঁছলেও অদ্ভুত ভাবে শেষ মুহূর্তে কাদের সতর্ক হয়ে গিয়েছে! গা-ঢাকা দিয়েছে নিপুণ ভাবে! কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ অবশ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কোনও অভিযোগ মানতেই নারাজ। তাঁর দাবি, কলকাতা পুলিশ সব রকম ভাবে চেষ্টা করেছে কাদের ও তার সঙ্গে পলাতক মহম্মদ আলিকে ধরার ব্যাপারে।
তা হলে কাদের এখন কোথায়? পুলিশের একটি মহল কাদেরের গতিবিধি নিয়ে একই সঙ্গে দু’-তিনটি সম্ভাব্য তত্ত্ব ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ বলছেন, কাদের পশ্চিম এশিয়ার একটি দেশে আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছে। নিম্ন আদালতের রায়ের পরে খুঁটিনাটি জানতে ইন্টারনেট কল-এর মাধ্যমে সে কলকাতায় তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিল।
গোয়েন্দাদের আর একটি সূত্র বলছে, বছরখানেক আগে শেষ বার কাদের বাংলাদেশ বা নেপালে ছিল বলে খবর মিলেছিল। স্বয়ং গোয়েন্দাপ্রধান বলছেন, ‘‘কাদের ও মহম্মদ আলি নামে পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের আর এক দুষ্কৃতীর নামে ইন্টারপোলে রেড কর্নার নোটিস বহু দিন জারি করা আছে। তা সম্প্রতি রিনিউও করা হয়েছে।
আমরা নিয়মিত ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’’
কিন্তু লালবাজারের ভিতরের একটা অংশ গোয়েন্দাপ্রধানের এই দাবি মেনে নিতে নারাজ। বরং ইন্টারপোলের নোটিস নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন তাঁরা। এই অংশের দাবি, কাদের আদৌ বিদেশে আছে কি না, সেটাই সন্দেহ! শাসক দলের কোনও কোনও নেতার ইন্ধনে প্রশাসনের একটা মহল কাদেরকে দেশের ভিতরেই গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে সাহায্য করে আসছে বলেও মনে করছেন লালবাজারেরই একটা অংশ।
লালবাজারের এক প্রবীণ অফিসারের দাবি, ‘‘ওই ছেলেটি (কাদের) উত্তরপ্রদেশের কোথাও লুকিয়ে আছে। কলকাতার তার কাছের লোকেদের সঙ্গেও সে দিব্যি যোগাযোগ বজায় রাখছে! ইন্টারপোলে নোটিস জারি করা-টরা সব আসলে লোক দেখানো ব্যাপার!’’
লালবাজারের ওই সূত্রটির দাবি, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের অধরা অন্য অভিযুক্ত মহম্মদ আলিও দেশের বাইরে যায়নি। সে বিহারে লুকিয়ে আছে বলে পুলিশের একটা অংশের দাবি। কিন্তু সত্যিই এদের ধরতে লালবাজার কতটা মরিয়া, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মনে করছেন এঁরা।
কলকাতা পুলিশের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় রয়েছে পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের অধরা দুই অভিযুক্ত মহম্মদ কাদের খান ও মহম্মদ আলি খানের নাম। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এদের কারও ছবিই নিজেদের ওয়েবসাইটে দেয়নি পুলিশ!
শুধু অভিযুক্তদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ৩৭ বছরের মহম্মদ আলি মোটাসোটা, ফর্সা, গোলগাল। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট। আর ২৭ বছরের যুবক কাদের খানের উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট। ফর্সা, মাঝারি গড়ন। মুখটি গোলাকৃতি। এমন নয় যে, কাদেরের কোনও ছবি পুলিশের কাছে নেই। পার্ক সার্কাসের নর্থ রেঞ্জের বাসিন্দা এই যুবকের নাড়ি-নক্ষত্র পুলিশের জানা।
পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর কোনও মামলার অভিযুক্তের ছবিটুকু পর্যন্ত কেন পুলিশ নিজেদের ওয়েবসাইটে দিতে পারল না, তা নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ সরকারি আইনজীবীর মতে, কাদেরই পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের মূল কুশীলব। বাকি অভিযুক্তরা প্রধানত তাকে সহযোগিতা করেছিল। তা-ই কাদের ধরা না-পড়া পর্যন্ত পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy