অনড়: বইমেলা প্রাঙ্গণে ঠায় দাঁড়িয়ে বহুরূপী গোপাল মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র।
দু’হাত মাথার উপরে তোলা। তাতে ধরা রং করা বাঁশের খুঁটি থেকে ঝুলছে সর্বশিক্ষা অভিযানের ছোট প্ল্যাকার্ড। কোমরে জড়ানো প্ল্যাকার্ডে লেখার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়— ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণা’। সামান্য ব্যবধানে পায়ের পাতা আগুপিছু করছেন। তবে ভিড়ের মধ্যে অনেকেই কিঞ্চিৎ সন্ত্রস্ত, ধাক্কা লাগলে যদি উল্টে পড়ে যায় চকচকে এই মূর্তিটি। তারই মধ্যে মূর্তির পেটের দিকে নজর পড়তেই এক জন বলে উঠলেন, ‘‘এ তো মূর্তি নয়, মানুষ!’’
সল্টলেকের করুণাময়ী মেলা প্রাঙ্গণে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন এ ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকছেন গোপাল মণ্ডল। উদ্দেশ্য, মেলায় আসা বইপ্রেমীদের মধ্যে শিক্ষার প্রচার চালানো। তবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজারামপুরের এই বাসিন্দা নিজেকে বহুরূপী বলতেই বেশি পছন্দ করেন।
কখনও কপিল মুনি, কখনও অন্য কিছু— যখন যা সাজবেন বলে মনে করেন, সেই মতোই পরিকল্পনা এবং অনুশীলন করেন পেশায় দিনমজুর গোপাল। এ বার কলকাতা বইমেলায় তিনি তাঁর নতুন ‘অবতারের’ জন্য বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাঁশের খুঁটি মাথার উপরে তুলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার অনুশীলন করেছেন কয়েক মাস ধরে। তাই বইমেলায় খোলা আকাশের নীচে, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া তাঁর রং করা আদুড় শরীরকে টলাতে পারে না। গোপালের কথায়, ‘‘সবই অভ্যাস। মানুষ আনন্দ পেলে সব কষ্ট, চিন্তা ভুলে যাই।’’
তবে চিন্তা কি সত্যিই নেই? সংসারে আর্থিক অনটনের জেরে বড় ছেলে রথীনকে দশম শ্রেণির পরে আর পড়াতে পারেননি। সে এখন গেঞ্জির কারখানায় কাজ করে। ছোট ছেলে, ষষ্ঠ শ্রেণির রনির ভবিষ্যতের জন্য ভাবনা তো রয়েছেই। তবু শিক্ষার জন্য প্রচার করছেন বছর ৪৭-এর গোপাল। যদিও সর্বশিক্ষা অভিযান বিভাগের কাছে যে সেই খবর নেই, তা বিলক্ষণ জানেন তিনি।
কিন্তু এ তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো! মানতে রাজি নন গোপাল। তাঁর কথায়, ‘‘এত মানুষ আমাকে দেখে আনন্দও তো পাচ্ছেন। শিক্ষার প্রচারের জন্য কাজও তো মানুষেরই জন্য।’’
শহরের বুকে এখন বহুরূপীদের দেখা পাওয়া ভার। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীনাথ বহুরূপীর গল্পও শুনেছেন গোপাল। তাঁর বহুরূপী সাজার ইচ্ছের জন্মও খানিক সেখান থেকেই। যে কোনও মেলা বা জমায়েতে নানা রূপে, ভিড়ের মধ্যেই নিজের অচল উপস্থিতি ঘটিয়ে অন্যকে আনন্দ দিতে চান তিনি। তবে তা করতে গিয়ে মার খায় তাঁর দিনমজুরির রোজগার। এ বার যেমন দিনমজুরির কাজ বন্ধ রেখেই এসেছেন কলকাতা বইমেলায়। মেলায় আসা লোকজন তাঁকে দেখছেন, ছবি তুলছেন, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে নিজস্বীও তুলছেন। তিনি যে মূর্তি নন, যাঁরা সেটা বুঝছেন, তাঁরা গোপালের কোমরে ঝোলানো ব্যাগে টাকা ফেলে দিচ্ছেন। তাতেই খুশি গোপাল। ‘‘এই যা রোজগার হচ্ছে, তাতে দিনমজুরির টাকা উঠে আসছে। আমারও খুব ভাল লাগছে।’’— অকপটে বলছেন তিনি।
তবে হাসিমুখে কথা বলার মধ্যেও গোপালের কথায় ঝরে পড়ে হতাশা। জানালেন, শিল্পী ভাতার জন্য সরকারি অফিসে বার বার যোগাযোগ করা সত্ত্বেও ভাতা মেলেনি। তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরাগী গোপালের অভিযোগ, ‘‘শিল্পী ভাতার আশায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিডিও অফিস থেকে কালীঘাট, সর্বত্র ছুটেছি। কিন্তু ভাতা মেলেনি। তবু প্রতি বছর ২১ জুলাই কলকাতায় এসে কিছু না কিছু সেজে দাঁড়িয়ে থাকি।’’
আর দুঃখ?
সামান্য হেসে গোপালের জবাব, ‘‘কষ্ট থাকলেও বুঝতে দিই না। আমি তো বহুরূপী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy