পুরভোটের মুখে কলকাতায় সম্পত্তি কর মকুবের এক অভিনব সিদ্ধান্ত নিল পুরসভা। সোমবার মেয়র পারিষদ বৈঠকে স্থির হয়েছে, এ বার থেকে কেউ তাঁর বসতবাড়ির বাইরের রঙ নীল-সাদা করলে তাঁর এক বছরের পুর-কর সম্পূর্ণ মকুব করা হবে। তবে অফিস বা বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে তা কার্যকর হবে না বলেই পুরসভা জানিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পছন্দের এই রঙে বিভিন্ন সরকারি ভবন, সেতু, রাস্তার রেলিং ইত্যাদি সাজিয়ে তোলা সারা রাজ্যে চালু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। এ বার পুরসভার ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতার করদাতারা সবাই যদি তাঁদের বসতবাড়ির রঙ নীল-সাদা করে ফেলেন, তা হলে সহজ অঙ্কে পুরসভার আয় অন্তত কয়েকশো কোটি টাকা কমে যাবে।
কর মূল্যায়ন দফতর সূত্রের খবর, গত আর্থিক বছরে (২০১৩-২০১৪) বসতবাড়ি ও বাণিজ্যিক সংস্থা মিলিয়ে সম্পত্তি কর থেকে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। কলকাতা পুর এলাকায় মোট করদাতা বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ ৬০ হাজার। শুধু বসতবাড়ির ক্ষেত্রে করছাড়ের এই ব্যবস্থা চালু করা হলেও পুরসভার ভাঁড়ারে আদায় অন্তত অর্ধেক হয়ে যাবে। সেই ঘাটতি ভরাট হবে কোন ভাণ্ডার থেকে, তার কোনও জবাব অবশ্য পুরকর্তারা দেননি।
অনেকের মতে, এই করছাড়ের আসল কারণ রাজনৈতিক। যার মূলে আছে বিজেপির উত্থান। এ বার লোকসভা ভোটে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরে বিজেপি এগিয়ে। এ ছাড়া, সারা কলকাতার ১৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিজেপির দখলে গিয়েছে ২৬টি। নিজেদের হাতে থাকা তিনটি ধরে রেখে আরও ২৩টি ওয়ার্ড জিতেছে এই দল। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। রাজ্যে বামেরা কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে এখানে মাথা তুলতে সক্রিয় বিজেপি। এই অবস্থায় পুরভোটের আগে বছর খানেক সময়ের মধ্যে ঘর গুছোতে রীতিমতো মাথা ঘামাতে হচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে। সোমবারের এই ‘জনমোহিনী’ পুর-সিদ্ধান্ত তারই প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই এ যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন বলেন, “পুর-ভাণ্ডারে এমনিতেই দেউলিয়া অবস্থা। সেখানে অহেতুক, অযৌক্তিক কারণে এই উদ্ভট সিদ্ধান্ত কেন! আসলে পুরভোটের আগে নিজেদের স্বার্থে তৃণমূল এটা করছে।”
এই সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ বেআইনি বলে জানিয়েছেন পুরসভার সিপিএমের প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “উদ্দেশ্য খুবই খারাপ। যাঁরা ওই আহ্বানে সাড়া দেবে, তাঁরা তাঁদের দলেরই সমর্থক। আর বাকিরা নয়। এটা চিহ্নিত হয়ে যাবে। যা গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক। হিটলারি কায়দা।” পুরভোটের আগে এসব করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। বিকাশবাবুর কথায়, করদাতা সকলেই। আর সেই টাকায় নগর পরিষেবা পান পুরবাসী। যাঁরা নীল-সাদা রঙ করবে না, তাঁদের জমা দেওয়া করের টাকার সুবিধা নেবে অন্য কেউ। “এটা হতে পারে না।”বলছেন প্রাক্তন মেয়র।
এ দিন বৈঠকের পর মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানান, শহরের সৌন্দর্যায়নের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সুরে রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, “পুরভোটের বা রাজনীতির সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের সম্পর্ক নেই। এই করছাড় হবে শুধু বসতবাড়ির ক্ষেত্রে। কোষাগারে তার কোনও আহামরি প্রভাব পড়বে না।”
যদিও অর্থনীতিবিদ অনুপ সিংহ বলেন, “কোনও নেতানেত্রীর ব্যক্তিগত পছন্দকে গুরুত্ব দিতে সরকারি কোষাগারের ক্ষতি করা নিবুর্দ্ধিতার পরিচয়।”
শুধু কোষাগার নয়, প্রশ্ন রয়েছে পুর-আইন নিয়েও। পুরসভারই একাধিক কর্তা বলছেন, এ ভাবে করছাড় দেওয়ার আইন পুরসভায় নেই। তা হলে কী ভাবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে?
মেয়র বলছেন, এই কর ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের অনুমতি চেয়ে পুরসভা থেকে একটি প্রস্তাব পাঠানো হবে। সেই অনুমতি এলেই ছাড় দেওয়া শুরু হয়ে যাবে বলে তাঁর দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy