মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বিস্ফোরক শোভন চট্টোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সদ্য তৃণমূল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। কেন এই সিদ্ধান্ত, তা নিয়ে এ বার মুখও খুলতে শুরু করেছেন স্বাভাবিক ভাবেই। তবে প্রশ্ন শুধু দলবদলের কারণ নিয়ে নয়। ঠিক কোন কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দূরত্ব? বিজেপি ঠিক কী আশ্বাস দিয়ে তাঁকে দলে নিল? এ বার তাঁকে কোন ভূমিকায় দেখা যাবে? এই গোটা প্রক্রিয়ায় বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা ঠিক কেমন ছিল? এমন গুচ্ছ প্রশ্ন ঘুরছে এখন শোভন চট্টোপাধ্যায়ের চার পাশে। আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সব প্রশ্নের উত্তরই দিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকে শোনা যাচ্ছিল যে আপনি বিজেপিতে যেতে পারেন। শেষ পর্যন্ত বিজেপিতেই যোগ দিলেন। এই পদক্ষেপই যদি করার ছিল, তা হলে এত দেরি করলেন কেন? কী কারণে আটকে ছিল?
শোভন: আটকে থাকার বিষয় নয়। যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, তখনই নিয়েছি। আপনারা কবে থেকে কী শুনতে পাচ্ছিলেন, আমার জানা নেই। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে সত্যিই আমার সঙ্গে কোনও বিজেপি নেতার কথা হয়নি। তৃণমূলে আমার সম্মান থাকছিল না, আমার মান-মর্যাদাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোনও রাজনৈতিক বিষয়কে তুলে ধরে নয়, আমার ব্যক্তিগত তথা পারিবারিক জীবনকে টেনে এনে আমাকে ক্রমাগত অপদস্থ করার চেষ্টা চলছিল। তাই তৃণমূল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, তখনই আমি বিজেপির সঙ্গে কথা শুরু করেছিলাম। প্রয়োজন হলে আমি রাজনীতি ছেড়েও দিতে পারতাম। কিন্তু আমার শুভানুধ্যায়ীরা, আমার অনুগামীরা গত আট মাসে আমাকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, তৃণমূলের এই নেতিবাচক রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা দরকার। পরে বিজেপির তরফ থেকেও আন্তরিকতার আভাস পাচ্ছিলাম। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ যে ভাবে আমার সঙ্গে দেখা করে আমাকে সঙ্গে চেয়েছিলেন, তার জন্য আমি দিলীপবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ। যখন মনে হয়েছে বিজেপিতে আমি মান-সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারব, তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
দিল্লিতে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সময় মুকুল রায়ের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।
আরও পড়ুন: মশা মারার ধোঁয়া বন্ধ করো, বাবাকে বলে দিলেন রত্না
প্রশ্ন: আপনি বলছেন, লোকসভা নির্বাচনের আগে কোনও বিজেপি নেতার সঙ্গে আপনার কথা হয়নি। কিন্তু বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো তাঁদের কথা হয়েছিল। বৈশাখীদেবী সে কথা স্বীকারও করেছিলেন।
শোভন: হ্যাঁ, বৈশাখীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লোকের দেখা হয়, কথা হয়। তখনও হয়তো হয়েছিল। কিন্তু কোনও সুসংহত প্রস্তাব আমার কাছে ছিল না। যখন সে প্রস্তাব এসেছে, আমি আমার কথাও জানিয়েছি। দু’পক্ষই যখন এক জায়গায় আসতে পেরেছি, তখন দলে যোগদান করেছি।
প্রশ্ন: যে দিন বিজেপিতে যোগদান করলেন, সে দিন বিজেপি দফতরে আচমকা একটা নাটক তৈরি হয়ে গেল। হঠাৎ দেবশ্রী রায় হাজির হলেন। শোনা গেল তিনিও যোগদান করছেন। তার পরে শোনা গেল, আপনি নাকি বেঁকে বসেছেন, তাই দেবশ্রীর যোগদান আটকে গিয়েছে। আসলে কি আপনি বেঁকে বসেছিলেন? নাকি বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে আপনি বেঁকে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন?
শোভন: এ সব আজগুবি খবর কোথা থেকে পান, জানি না। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় আলাদা অস্তিত্ব, আমি আলাদা অস্তিত্ব। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে, আমরা পরস্পরের খুব ভাল বন্ধু। এ কথা ঠিক যে, আমরা পরস্পরের পরিপূরক। এ কথা ঠিক যে, আমরা যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করার আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি। এ কথাও ঠিক যে, আমরা দু’জনে একই সঙ্গে বিজেপিতে যোগদান করেছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা কেউ কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা কারও চাপে কিছু করি। দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে একই দলে থেকে রাজনীতি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে কথা বিজেপি নেতৃত্বকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছিলাম। আমি কৃতজ্ঞ যে, তাঁরা আমার বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও ভূমিকা নেই।
প্রশ্ন: কিন্তু দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে এক দলে থেকে কাজ করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয় কেন? এক সময়ে তো খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। অনেকেই বলেন যে, রায়দিঘি থেকে দু’বার দেবশ্রী রায়কে জিতিয়ে আনার পিছনেও আপনার বড় ভূমিকা ছিল।
শোভন: আমি পরিষ্কার করে বলি, দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে আমার কোনও যোগসূত্র কয়েক বছর ধরে নেই। ওঁর জন্য প্রচুর অপমান আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। উনি একজন অকর্মণ্য বিধায়ক। যেখান থেকে দু’বার জিতেছেন, সেই এলাকার কোনও মানুষ কোনও কাজে দেবশ্রীকে পাশে পেতেন না, এখনও পান না। আর আমাকে জবাবদিহি করতে হত, আমাকে অপমানের মুখে পড়তে হত।
প্রশ্ন: সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণ শুধু এইটুকুই?
শোভন: না, শুধু এইটুকু নয়। আপনারা জানেন, আমার পরিবারের মধ্যে একটা সমস্যা চলছে। আমার স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায় আমার জন্য খুব বড় একটা সঙ্কট তৈরি করেছিলেন। আমার সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। আমাকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলেন। তার জেরে আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। দেবশ্রী রায় সেটার অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। এঁদের সঙ্গে কাজ করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়, আমি বিজেপি নেতৃত্বকে স্পষ্ট করে জানিয়েছিলাম।
বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় ও শোভন চট্টোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: দেবশ্রী-পর্ব দুঃস্বপ্ন, তা ভুলে যান, শোভনদের বার্তা শিব প্রকাশের, রাখি বাঁধলেন বৈশাখী
প্রশ্ন: রত্না চট্টোপাধ্যায় তো উল্টো কথা বলছেন। তিনি তো আপনার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলছেন। যাঁকে আপনি ‘বিপদের বন্ধু’ বলেন, সেই বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সংসার ভাঙানোর অভিযোগ তুলছেন।
শোভন: রত্না চট্টোপাধ্যায়ের এই সব কথার জবাব দিতে হলে যতটা নীচে নামা দরকার, ততটা নীচে আমি নামতে পারব না। তবে একটা কথা আপনাদের জেনে রাখা উচিত। আমার পরিবারে ভাঙনটা ধরেছে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক যুবকের সঙ্গে রত্নার সম্পর্কের কারণে। সেই সম্পর্ক ২০০৮ সাল থেকে। আর বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ২০১৬ সাল থেকে। নিজের গায়ের কালিটা রত্না চট্টোপাধ্যায় আমার গায়ে বা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়ে মোছার চেষ্টা করতে পারেন। ওঁর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে বাস্তব বা সত্য বদলে যাবে না।
প্রশ্ন: একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। বিজেপি আপনাকে কলকাতা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বড় ভূমিকা নিতে বলবে— এই রকম একটা তত্ত্ব উঠে এসেছে। আপনি নিজেও নাকি তেমনটাই চাইছিলেন। আপনার বিজেপিতে যোগদানের সাংবাদিক সম্মেলনে মুকুল রায়ও বিশেষ ভাবে উল্লেখ করলেন কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আপনার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা। এটা কি আপনার বিজেপিতে যোগদানের শর্ত ছিল?
শোভন: আবার বলছি, কোনও শর্ত দিয়ে আমি বিজেপিতে আসিনি। আমি বিজেপি নেতৃত্বের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছি। আর যোগদানের আগে আমি শুধু জানিয়েছি যে, মর্যাদার সঙ্গে কাজ করতে চাই। কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার দায়িত্ব আমি নিতে চাই বা বিজেপি আমাকে সে রকম দায়িত্ব দিতে চায়, এ রকম কোনও আলোচনা আমার সঙ্গে কারও হয়নি।
প্রশ্ন: আপনি মন্তব্য করতে চাইছেন না ঠিকই। কিন্তু বিজেপির হয়ে আপনি কোন ভূমিকা পালন করবেন, তা নিয়ে কিন্তু জোরদার জল্পনা চলছে কলকাতায়।
শোভন: যেমন?
প্রশ্ন: শোনা যাচ্ছে ২০২০ সালে কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে আপনাকে মেয়র হিসেবে তুলে ধরে লড়াইয়ে যেতে পারে বিজেপি।
শোভন: একটা কথা আপনাদের কত রকম ভাবে বোঝালে আপনারা বুঝবেন, আমি মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না। স্পষ্ট কথা শুনুন, আমি চিরকালই নেতা হওয়ার চেয়ে কর্মী হতে বেশি ভালবাসি। সুতরাং পদ নিয়ে ভাবার প্রশ্নই ওঠে না। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে ভারতীয় জনতা পার্টি যে ভাবে এগিয়ে আসছে, তাতে এই দলের হয়ে কাজ করার সুযোগ পাওয়াই খুব বড় ব্যাপার আমার কাছে। দল যে কাজ দেবে, সেই কাজই করব।
প্রশ্ন: আচ্ছা সে কথা না হয় বাদই দিলাম। আপনি বলুন, আপনার ছেড়ে যাওয়া পদে ফিরহাদ হাকিমকে দেখতে আপনার কেমন লাগছে?
শোভন: দেখুন, এটা একটা অঙ্গীকারের বা একটা দায়বদ্ধতার প্রশ্ন ছিল। ২০১০ সালে আমি যখন মেয়র হই, তখন দলই আমাকে মেয়র করেছিল। মানে তৃণমূল পুর নির্বাচনে জিতল। তার পরে আমাকে মেয়র করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু ২০১৫ সালে বিষয়টা সে রকম ছিল না। সে বার আমি মেয়র পদে থেকে নির্বাচনে গিয়েছিলাম। আমাকে সামনে রেখে তৃণমূল লড়েছিল। জিতলে আবার আমিই পুরসভা পরিচালনা করব— এই ধারণা নিয়ে কলকাতাবাসী ভোট দিতে গিয়েছিলেন। তার পরে মাঝপথে আমাকে মেয়র পদ থেকে সরে যেতে বলাটাই তো সবচেয়ে বড় অনৈতিকতা ছিল। কিন্তু আমি কারও বিড়ম্বনার কারণ কোনও দিনই হতে চাইনি। আমাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পছন্দ হচ্ছে না, এ কথা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নটার স্পষ্ট উত্তর দিলেন না। মেয়র হিসেবে ফিরহাদ হাকিমকে কেমন লাগছে?
শোভন: ব্যাপারটা কী জানেন তো, সবটাই তো গড়ে দিয়ে আসা হয়েছে। ২০১০ সালের পর থেকে কলকাতার পুর পরিষেবা অন্য গতিতে এগিয়েছে। সামান্য বেশি বৃষ্টি হলে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় আগে তিন দিন ধরে জল জমে থাকত। এখন এক-দেড় ঘণ্টায় জল নেমে যায়। এই পরিবর্তন তো এমনি এমনি হয়নি। এর পিছনে তো একটা বিজ্ঞান আছে। পানীয় জল সরবরাহ আগে কেমন হত, এখন কেমন হয়? জঞ্জাল অপসারণের পরিকাঠামো আগে কেমন ছিল, এখন কেমন? পুরকর নিরূপণ আগে কী ভাবে হত, এখন কী ভাবে হয়? সবই আপনারা নিজের চোখেই দেখছেন। পুর পরিষেবার এই মৌলিক বিষয়গুলোয় বদল যে ২০১০ সালের পর থেকেই এসেছে, সে-ও আশা করি জানেন। ফিরহাদ হাকিমকে নতুন কিছুই করতে হয়নি এখনও পর্যন্ত। যা তিনি উদ্বোধন করছেন, সে সবও আমারই করে করে আসা।
প্রশ্ন: তা হলে ফিরহাদ হাকিম আপনার ‘সুকর্মের’ ফল ভোগ করছেন? এটাই বলতে চাইছেন?
শোভন: ফলটা যদি তিনি ভোগ করতে পারতেন, তা হলে সত্যিই খুশি হতাম। কিন্তু ভোগ করতে বোধহয় পারছেন না। পুর পরিষেবার কাঠামো যে ভাবে ঢেলে সাজিয়ে এসেছিলাম, সেটাও বোধহয় বহাল রাখতে তিনি পারছেন না। ফিরহাদ হাকিম যেখানে থাকেন, সেই চেতলাতেই একটা হোর্ডিং দেখলাম— ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’। হোর্ডিংটা খুব প্রতীকী লাগল আমার। ওই হোর্ডিংয়ের মাধ্যমে কলকাতার বর্তমান মেয়র বোধ হয় নিজেই মেনে নিলেন যে, কলকাতার পুর পরিষেবায় আর স্থিতিশীলতা নেই। কলকাতা এখন নড়বড় করছে।
প্রশ্ন: ১৯৮৫ সালে এক ধুন্ধুমার নির্বাচনে জিতে কলকাতা পুরসভায় ঢুকেছিলেন। তখন কংগ্রেসে। পরে মেয়র পারিষদ হয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। তার পরে নিজেই পর পর দু’বার মেয়র হয়েছেন। এখন আবার বিরোধী শিবিরে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিও ফের খুব উত্তপ্ত। ২০২০ সালে কি আবার সেই ১৯৮৫-র মতো কোনও ধুন্ধুমার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছেন?
শোভন: হতেই পারে। পঞ্চায়েত নির্বাচন কী ভাবে হয়েছে, আপনারা দেখেছেন। স্থানীয় পর্যায়ের যে কোনও নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে এখন কী ভাবে হচ্ছে, আপনারা দেখছেন। সুতরাং কলকাতাতেও তেমন ঘটনাই যে ঘটানোর চেষ্টা হবে, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু যাঁরা ভাবছেন কলকাতার দখলও ওই কায়দাতেই ধরে রাখবেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।
মেয়রের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার দিন শোভন চট্টোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: দিল্লি গেলেন সব্যসাচী, জোরদার দলবদলের জল্পনা
প্রশ্ন: আপনি কি কোনও ভাবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন? কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা চেয়ে আপনি অমিত শাহকে চিঠি দিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
শোভন: না, ভুল শুনেছেন। অমিত শাহকে আমি এ রকম কোনও চিঠি দিইনি। তবে আমার নিরাপত্তা যে প্রশ্নের সম্মুখীন, সেটা কারও অজানা নয়। আমার বাড়ি ঘিরে যে ধরনের কার্যকলাপ ঘটানো হয়েছিল, রায়চকে আমাদের ঘিরে যা ঘটানো হয়েছিল— আপনারা জানেন। আর আমার যে নিরাপত্তা জরুরি, সে রিপোর্ট তো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গোয়েন্দারাই দিয়েছিলেন। সেই কারণেই তো আমাকে জেড ক্যাটিগরি দেওয়া হয়েছিল।
প্রশ্ন: সেই জেড ক্যাটিগরি তো এখন পাচ্ছেন না। তা হলে কি কেন্দ্রের কাছে চাইবেন?
শোভন: জেড ক্যাটিগরি পাচ্ছি না ঠিকই। কিন্তু রাজ্য এখনও আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। আমি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে দেবে কি না জানি না। যদি আর না দেয়, তা হলে কেন্দ্রের কাছে চাইব। তবে আবার বলি, অমিত শাহকে আমি এখনও কোনও চিঠি দিইনি।
প্রশ্ন: প্রথমে কংগ্রেস। তার পরে তৃণমূল। দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আজ তাঁর ঠিক বিপরীত মেরুতে। যাঁর হাত ছেড়ে এলেন, তাঁর সম্পর্কে কী বলবেন?
শোভন: যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতাম, তাঁকেই যদি এখনও পেতাম, হাত ছাড়ার প্রয়োজন হয়তো পড়ত না। এখন যাঁকে দেখি, তিনি আমার চেনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন।
প্রশ্ন: এইটুকুই?
শোভন: আসলে ওঁর অনৈতিকতা সম্পর্কে বলতে গেলে অন্তত এক ঘণ্টা বলে যেতে হবে। আজ তিনি আমার দায়বদ্ধতা বা নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। রত্না চট্টোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছেন। এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তো বলেছিলেন, রত্নাকে ডিভোর্স দিতে। রত্না আমার সঙ্গে কত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানানোর পরে তিনিই আমাকে বলেছিলেন— তুই এখনই বাড়ি ছাড়, রত্নার মতো মেয়ের সঙ্গে তুই ঘর করতে পারবি না, তুই ওই বাড়িতে থাকলে খুন হয়ে যাবি, তোকে আমি অন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ক্যাবিনেটের সামনে তিনি এ সব কথা বলেছিলেন। রত্না চট্টোপাধ্যায় যে আমার সন্তানদের বিপথে পরিচালিত করছেন, রত্না চট্টোপাধ্যায় যে ওদের অশিক্ষা দিচ্ছেন, রত্না চট্টোপাধ্যায় যে আমার সন্তানদের ব্যবহার করতে চাইছেন আমার বিরুদ্ধে— এ সব কথা তো তিনিই বলেছিলেন। ক্যাবিনেটের অন্য সদস্যরা সাক্ষী। এখন তিনিই আবার রত্নার পাশে থাকার বার্তা দিচ্ছেন। অনৈতিক তা হলে কে!
প্রশ্ন: অর্থাৎ আপনার ব্যক্তিগত সঙ্কটে আপনার পাশে না দাঁড়ানোই আপনার সঙ্গে মমতার দূরত্বের প্রধান কারণ।
শোভন: না। আমার পারিবারিক সঙ্কটটাকে উনি ব্যবহার করলেন মাত্র। তৃণমূল অনৈতিক পথে যাচ্ছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণতন্ত্রের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা দেখে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম, নির্বাচনকে এই রকম প্রহসনে পরিণত করার কোনও দরকার ছিল না। সুতরাং আমাকে এ বার সরানোর দরকার ছিল। তাই আমার পারিবারিক সঙ্কটটাকে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হল।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন। মমতার সঙ্গে থাকা শোভন আর মমতাকে ছেড়ে আসা শোভন— দু’জন কি একই রকম শক্তিশালী হবেন?
শোভন: নেতা কখনও শক্তিশালী হন না। জনগণ নেতাকে শক্তিশালী বানান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হননি। আমরা ছিলাম বলেই হয়েছেন। মমতা যেমন আমাদের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন, একই ভাবে আমাদের মতো বেশ কয়েক জনের রাজনৈতিক সংগ্রামও মমতাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। যাঁদের উপর ভর করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন তিনি, তাঁদের ক’জন এখন ওঁর সঙ্গে রয়েছেন? একটু হিসেব করে দেখুন। তা হলেই বুঝবেন, কার প্রতিষ্ঠা প্রশ্নের মুখে পড়তে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy