ইসলামপুরের দাড়িভিট স্কুল।—নিজস্ব চিত্র।
সন্ধে নামলে আগেও অন্ধকার হত দাড়িভিটে। কিন্তু, এখন তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে ভয়ের আবহ।
সেই অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে আসে একগুচ্ছ শব্দ। বুটের আওয়াজ। দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ। গ্রামের পথে দৌড়োদৌড়ির আওয়াজ। বাদ পড়ে না দোলঞ্চা নদীর পাড়ও। সেখানেই মাটির তলায় সমাধিস্থ করে রাখা হয়েছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত দুই ছাত্র রাজেশ এবং তাপসকে। গত কয়েক দিন ধরে এমনই অভিজ্ঞতা দাড়িভিটের।
আর সে সবকে এড়াতে গোটা গ্রামটাই বিকেলের পর থেকে পুরুষ শূন্য হয়ে যায়। সর্বত্রই আতঙ্ক। দিনের বেলাতেও থমথমে গ্রাম। আর এই আতঙ্কটাই গোটা গ্রামকে ফের একত্রিত করেছে।
দাড়িভিট স্কুলের দিকে যেতেই জটলাটা চোখে পড়ল। স্কুলমাঠের কাছে ভিড়টা আরও একটু দলা পাকানো। একটা চাপা ফিস ফিস। জোরে কেউ কথা বলছেন না।
আবার কিছু হয়েছে নাকি? ভিড়ের মধ্যে থেকে এক যুবক বাক্যগুলো ছুড়ে দিলেন— ‘‘কী আবার হবে দাদা! পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা একসঙ্গে রয়েছি।’’
গত বৃহস্পতিবার ভয়ানক সেই গন্ডগোল হয়েছিল এই জায়গাতেই। এখানেই গুলি লেগেছিল রাজেশ, তাপস, বিপ্লবদের গায়ে। আজ সেই ঘটনার অষ্টম দিন। কিন্তু, পুলিশের ভূমিকায় প্রবল ক্ষুব্ধ দাড়িভিটের বাসিন্দারা। একে তো পুলিশ ওই ঘটনার গোটা দায়টাই চাপিয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীদের ঘাড়ে। উল্টে, গ্রাম জুড়ে তল্লাশি চালানোর নামে ব্যাপক ধরপাকড় করছে বলে অভিযোগ। আর সে সব নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন। কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাইছেন। সবটাই দলবদ্ধ ভাবে। ‘‘দুষ্কৃতীরা নাকি গুলি চালিয়েছে! বন্দুক খুঁজে পেয়েছে পুলিশ?’’, ‘‘ক’জন দুষ্কৃতীকে ধরেছে পুলিশ?’’— ওই জটলা থেকে সেই প্রশ্নগুলোই উড়ে এল। কেউ নিজের নাম বলতে চাইলেন না। তুলতে দিলেন না ছবিও।
কয়েক দিন ধরে পুলিশি ধরপাকড়ে অতিষ্ট হয়ে এ ভাবেই একজোট হয়েছেন গ্রামবাসীরা। এখন আর দুই ছাত্রের মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদের মধ্যেই আন্দোলন সীমাবব্ধ নেই, ‘পুলিশি অত্যাচারে’র বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে দাড়িভিট। রাতের অন্ধকারে পুলিশ আসছে। বাড়ির পর বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পুরুষরা রাতে তাই গ্রামছাড়া। বন্ধের দিন সকাল থেকে দাড়িভিটে আর পুলিশ টহল দিচ্ছে না। আজও একই অবস্থা। থমথমে পরিবেশ। নিস্তব্ধ দাড়িভিট স্কুল। বুধবার বন্ধের দিন তৃণমূল তাণ্ডব চালিয়েছে। সেই সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। এমন অভিযোগ তুলে তারই প্রতিবাদে আজ ইসলামপুরে ব্যবসায়ীরা বন্ধ ডেকেছেন। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। সব মিলিয়ে, পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ কমছে না দাড়িভিটের। আর এই পুলিশ বিরোধিতাই ফের তাদের একত্রিত করে তুলেছে।
ওই দিন ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়েছিল কে? মৃত রাজেশ-তাপসের পরিবার এবং গুলিবিদ্ধ বিপ্লব দাবি করেছে, পুলিশ। এ দিন ওই জটলা থেকেও সমস্বরে একই জবাব এল, “পুলিশই গুলি চালিয়েছে।” পাশের রাস্তা দিয়ে মাঠে চাষ করতে যাচ্ছিলেন দাড়িভিটের এক বৃদ্ধ। জটলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কথাটা তাঁর কানেই গিয়েছিল। সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে বেশ জোর গলায় বললেন, “যদি দুষ্কৃতীরাই গুলি চালায়, তা হলে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না কেন বলুন তো? পুলিশের হাতে তো অনেক ক্ষমতা। নিরীহ গ্রামবাসীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর ওদের ধরতে পারছে না! আমরা রাজনীতি চাই না। পতাকা ছাড়াই আন্দোলন চলবে।”
গ্রামবাসীদের প্রশ্নগুলো জানানো গেল উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার সুমিত কুমারকে। পাশাপাশি প্রশ্ন করা হল, দুষ্কৃতী গ্রেফতার হল? মৃতদের দেহ থেকে কি গুলি মিলেছে? আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে? এই জেলায় সদ্য কাজে যোগ দেওয়া পুলিশ সুপার সটান বললেন, “এ সব বলা যাবে না। কাজ করতে দিন।” যদিও তাঁর দফতরেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, আগ্নেয়াস্ত্র বা গুলি কিছুই পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: ‘ছাত্রদের এমন রূপ দেখতে হবে কোনও দিন ভাবিনি’
আরও পড়ুন: আন্দোলনের রং নিয়ে দু’ভাগ দাড়িভিট
পুলিশ এখন এই ঘটনায় বিহারী দুষ্কৃতীদের ‘ভূত’ দেখছে। বুধবার ইসলামপুরের সভায় রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী তথা তৃণমূলের উত্তরদিনাজপুর জেলা পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘বিহার থেকে লোকজন এসে গোলমাল পাকাচ্ছে। সন্ত্রাস চালাচ্ছে।’’ তার পর থেকেই পুলিশের তদন্ত সে পথেই এগোচ্ছে বলে গ্রামবাসীদের একাংশের অভিযোগ। ইসলামপুর লাগোয়া কিষানগঞ্জ এলাকা বিহারের মধ্যেই পড়ে। এমনিতেই ইসলামপুরে বাংলার পাশাপাশি হিন্দি, উর্দুভাষী মানুষজনের সংখ্যা বেশি। ব্যবসার কারণে কিষানগঞ্জ থেকে ইসলামপুরে যাতায়াত করতে হয় বহু মানুষকে। তদন্তকারীদের একটা অংশের অনুমান, ঘটনার দিন একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে বিহারী দুষ্কৃতীরা দাড়িভিটে ঢুকেছিল। তারাই গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়।
কিন্তু গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, বিশাল বাহিনী নিয়ে সে দিন দাড়িভিটে এল পুলিশ আর দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করতে পারল না?
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
(মালদহ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং সহ উত্তরবঙ্গের খবর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা খবর পড়ুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy