বিজেপি কি লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার তৃণমূল নেতা, বিধায়কদের জন্য দলের দরজা হাট করে খুলে দিতে চাইছে?
গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে আসার ‘স্রোত’ দেখা গিয়েছিল। অনেক আগেই এসেছিলেন মুকুল রায়। ভোটের পরে তিনি ফিরে গিয়েছেন। মুকুলের পরে পরে এসেছিলেন সব্যসাচী দত্ত। ভোটে প্রার্থী হয়ে পরাজিত সব্যসাচীও ফিরে গিয়েছেন ‘ঘরে’। তবে বড় স্রোত দেখা গিয়েছিল শুভেন্দু অধিকারী যোগ দেওয়ার পরে। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর শুভেন্দুর সঙ্গে এক ডজন সাংসদ, বিধায়ক বিজেপিতে এসেছিলেন। পরাজিতরা তো বটেই, মুকুল বা শুভেন্দুর হাত ধরে বিজেপিতে এসে জয়ীরাও অনেকেই ফিরে গিয়েছেন তৃণমূলে। পরাজিত রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর ঘোষালরা যেমন ফিরেছেন, তেমনই তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন হয়েছে পদ্মের টিকিটে জয়ী মুকুল, কৃষ্ণ কল্যাণীদেরও।
বিজেপি কি লোকসভা নির্বাচনের আগে আবার তৃণমূল নেতা, বিধায়কদের জন্য দলের দরজা হাট করে খুলে দিতে চাইছে? এমন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা মিঠুন চক্রবর্তী। আর তাতে ইন্ধন জুগিয়েছেন স্বয়ং রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। অভিনেতা থেকে রাজনীতিক হয়ে উঠতে-চাওয়া মিঠুন গত বিধানসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের হয়ে প্রচারে নামলেও তাঁর হাত ধরে কেউ দল বদলায়নি। কিন্তু এ বার তিনি নাকি অনেককে নিয়ে আসতে পারেন! প্রথমে মিঠুন দাবি করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তৃণমূলের ২১ জন বিধায়ক। মঙ্গলবার সেই সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৮ করেছেন। বলেছেন, ‘‘আসলে ২১ জন নয়, আমি ৩৮ জনের (পড়ুন তৃণমূল বিধায়ক) কথা বলেছি। এ ছাড়াও আরও তৃণমূল বিধায়ক আছেন, যাঁরা সরাসরি দিল্লির (বিজেপির) সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।’’ মিঠুনের পাশে বসা সুকান্ত বলেন, ‘‘মিঠুনদার কাছে যদি ২১ জনের নাম থাকে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে ৪১ জনের কম নাম থাকবে না।’’
কিন্তু কারা আসছেন বিজেপিতে? কারা যোগ দিতে চাইছেন? শাসক শিবির তৃণমূলের মতো বিজেপিতেও এ নিয়ে কৌতূহল। সবার মনেই প্রশ্ন, তালিকায় কাদের নাম রয়েছে? বুধবার এ নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের জবাবে সুকান্ত বলেন, ‘‘আমাদের দলে তো একজনের সঙ্গে কথা বলে যোগ দেওয়া যায় না! তা ছাড়া গোটা বিষয়টাই দেখবেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তবে আমরা কোনও পচা আলু নেব না। যাঁরা আসতে চাইছেন, তাঁরা সবাই সুযোগ পাবেন এমনটা নয়।’’ কিন্তু কোনও আন্দাজ কি পাওয়া যেতে পারে কারা রয়েছেন তালিকায়? উত্তরে সুকান্ত বলেন, ‘‘সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।’’
ঠিক এমন সুরই মঙ্গলবার শোনা গিয়েছিল মিঠুনের মুখে। হুগলিতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এত স্পষ্ট করে বলব না। আমি প্রোটোকল মেনে কথা বলি। শীর্ষ নেতৃত্বকে আমি জানিয়েছি। তাঁদের নির্দেশেই আমি এখানে এসে এই কথা বলছি।’’
বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল থেকে অনেককে নিয়ে দলকে ভুগতে হয়েছে বলে বিজেপির অন্দরেও আলোচনা শোনা যায়। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মিঠুন কী করে রাজি করালেন নেতাদের? মিঠুন দাবি করেছেন, ‘‘দল বলে দিয়েছিল তৃণমূল থেকে কাউকে নেব না। ন্যাড়া এক বারই বেলতলায় যায়। কিন্তু আমি তাঁদের বুঝিয়েছি। তবে পচা আলু আমরা নেব না। কেউ চুরি করলে সেটার দোষ অন্যের উপর গিয়ে দোষে। কিন্তু আমি তাঁদের বিশ্বাস করাতে পেরেছি যে, যাদের নাম আমি নিচ্ছি, তাঁরা এ সবের মধ্যে নেই।’’তৃণমূল বরাবরই বিজেপির বিরুদ্ধে নেতা কেনাবেচার অভিযোগ তুলে আসছে। সেটা শুধু এ রাজ্যেই নয়, অন্যত্রও। সেই প্রসঙ্গে মিঠুনের বক্তব্য, ‘‘আমি যে ২১ জনের কথা বলেছি, তাঁদের কারও সঙ্গে কোনও টাকার কথা হয়নি। তৃণমূলের সবাই চোর নন। কিন্তু অনেকেরই দমবন্ধ হয়ে আছে।’’ মিঠুনের সুরে তৃণমূলের অনেকেই যোগাযোগ করছেন বলে দাবি করলেও সুকান্ত এটাও জানান যে, অন্য দলের ‘নেতা’ নেওয়ার থেকে ‘কর্মী’ নিতে তিনি বেশি আগ্রহী। সুকান্ত বলেন, ‘‘আমাদের দল বড় করতে হবে। সেই কারণে অনেক কর্মী দরকার। তার জন্য অন্য দল থেকে কর্মী তো নিতেই হবে। তবে সেটাও বাছাই করে। সেই প্রক্রিয়া চলছেও।’’
দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতি থাকার সময় ঠিক একই ভাবে অন্য দলের কর্মী নিতে চেয়েছিলেন। বিজেপি ‘যোগদান মেলা’ কর্মসূচি নিয়েছিল কর্মী নেওয়ার জন্যই। কিন্তু মুকুল বা কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের নেতৃত্বে নেতাদের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। এমনকি, তৃণমূল বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার পর জায়গা না পাওয়া বিক্ষুব্ধদের অনেকেই বিজেপিতে চলে আসেন। সেই তালিকায় ছিলেন সাতগাছিয়ার সোনালি গুহ থেকে সিঙ্গুরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যরা। কেউ কেউ যোগ দিয়েই প্রার্থী হয়ে যান। তবে ভোটে হেরেও যান।
ভোটে ভরাডুবির পরে ‘দলবদলু’ নেতাদের অনেকের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন বিজেপি শিবিরের নেতারা। আবার যাঁরা এই ‘যোগদান মেলা’-র নেপথ্যে ছিলেন, দলের সেই ‘বড়’ নেতাদের নিয়েও সমালোচনা হয়েছিল। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়ের মতো অনেকেই বলেছিলেন, ‘‘ভাড়াটে সেনা দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না।’’ দল কি আবার সেই পথেই হাঁটতে চলেছে? এমন প্রশ্ন উঠেছে বিজেপির অন্দরেই। পুজোর আবহে কেউ মুখ খুলতে না চাইলেও অনেকেই ফের ভুল পদক্ষেপের আশঙ্কা করছেন।
মিঠুন বা সুকান্ত এমন যোগদান সম্ভাবনার কথা বললেও দিলীপ অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি। একই ভাবে সংবাদমাধ্যমের এই সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু। তৃণমূল তবে মিঠুনের দাবিকে তেমন আমল দিতে চাইছে না। রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় মঙ্গলবারই বলেন, ‘‘চ্যালেঞ্জ রইল, তৃণমূলের একজন বিধায়ককে দলে নিয়ে দেখাক বিজেপি! ওদের রাজনীতি নেই, সামাজিক আন্দোলন নেই। মিঠুনবাবু সিনেমার মানুষ। রাজনীতিতেও সিনেমার সংলাপের মতো চমক আনতে চেয়েছেন।’’ আরও আক্রমণাত্মক ভাষায় তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘মিঠুন নিজেই নানা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত। অনেকগুলোর কথা আমরাই জানি না। উনি সে সব থেকে বাঁচতে বিজেপিতে গিয়েছেন। বিধানসভা ভোটের হার এখনও হজম হয়নি। পেটগরম থেকে এ সব বলছেন। আমি ওঁকে জোয়ানের হজমিগুলি পাঠিয়ে দেব।’’
বস্তুত, বিজেপির অনেকেও মনে করছেন শাসক শিবিরকে চাপে রাখতেই এটা দলের পুরনো পন্থা। মুকুলও বিজেপিতে আসার পরে নিয়মিত বলতেন যে,‘‘আমি চাইলে রাজ্য দফতরের সামনে তৃণমূল নেতাদের লাইন পড়ে যাবে।’’ সে কথাও ভোলেননি পদ্মশিবিরের লোকজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy