জানলায় চোখ রাখতেই মনে এল ছেলেবেলা। — নিজস্ব চিত্র।
শনিবার। রাত ১০টা ৪৫ মিনিট। শিয়ালদহ স্টেশন। ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে পদাতিক এক্সপ্রেস। এইচ-১ কামরার ‘এফ’ কুপের যাত্রীর জন্যই আসা। একই কামরার অন্য আসনে আমার সংরক্ষণ। আসন চিনে ব্যাগপত্তর রাখতে রাখতেই দেখলাম ‘ডি’ এবং ‘এফ’ কুপের আনাচেকানাচে গন্ধ শুঁকছে পুলিশের কুকুর।
রাত ১১টা। ট্রেন ছাড়বে রাত ১১টা ২০ মিনিটে। তিনি কখন আসবেন?
স্টেশনের অন্য প্রান্ত থেকে এক সহকর্মীর ফোন এল, ‘‘যাচ্ছেন।’’ দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখি, প্ল্যাটফর্ম ধরে একটা ভিড় এগিয়ে আসছে। ভিড়ের পিছনে একটা ব্যাটারিচালিত গল্ফ কার্ট। তার উপর বসে রয়েছেন তিনি— মিঠুন চক্রবর্তী। গেরুয়া রঙের পাঠানি কুর্তার উপর জড়ানো একটা সাদা শাল। মাথায় কালো টুপি। একগাল সাদা দাড়ি। পাশের আসনে সুকান্ত মজুমদার। গাড়ি ঘিরে রেখেছেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। সেই ভিড়ের মধ্যেই মিঠুনকে ফ্রেমবন্দি করছে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা।
১১টার কিছু পরে ট্রেনে উঠলেন মিঠুন। ঠিক সময়ে ছাড়ল ট্রেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ডাক এল ‘এফ’ কুপ থেকে। ঘড়ি দেখলাম, ১১টা ২৫ মিনিট। আনন্দবাজার অনলাইনের সফর শুরু হল ‘জাত গোখরো’-র সঙ্গে।
ট্রেনের সামনের দিকে ইঞ্জিনের কাছাকাছি প্রথম শ্রেণির কামরা। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা মিঠুনের পাশে বসে রাজ্য বিজেপির নেতা সভাপতি সুকান্ত। ট্রেন চলতে শুরু করার পরে ভিড় পাতলা। কুপের দরজা বন্ধ। বাইরে মোতায়েন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দুই জওয়ান। প্রথম প্রশ্ন এল মিঠুনের তরফেই, ‘‘রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছে?’’ খেয়েদেয়েই ট্রেনে উঠেছি জেনে বললেন, ‘‘আমি একটু দেরি করে খাব। সকাল থেকে যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই কিছু না কিছু খেতে হয়েছে। এখনও পেট খালি হয়নি।’’
কিন্তু কী খাবেন? ‘‘আমি কিছু আনিনি! স্টেশনেই এক জন দেখা করতে এসে খাবার দিয়ে গিয়েছে। আমায় খুব ভালবাসে। দেখি কী আছে। আমি তো সব খাই। সুগার আছে খুব সামান্য। আর তেমন কোনও অসুখবিসুখ নেই। ফলে ডাক্তারের তেমন বারণ নেই’’, বললেন মিঠুন।
কথা বলতে বলতেই সুকান্তের দিকে তাকিয়ে, ‘‘ও দিকের কথা হয়ে গিয়েছে?’’ সুকান্ত বললেন, ‘‘বালুরঘাটে ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই জানিয়ে দেবে।’’ কিন্তু ‘ও দিক’-টা কী? বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। বোঝা গেল, প্রাথমিক কর্মসূচি পুজো উদ্বোধন হলেও সেই ফাঁকে বালুরঘাটে সাংগঠনিক বৈঠক সারতে চান ‘রাজনীতিক’ মিঠুন। নিজেই সেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই মতোই ব্যবস্থা করতে হচ্ছে সুকান্তকে। ঠিক হল, বালুরঘাট শহরেরই একটি লজে হবে ওই জেলার সাংগঠনিক বৈঠক। সেখানে প্রধান বক্তা মিঠুন। সুকান্ত ছাড়াও থাকবেন বালুরঘাটের বিধায়ক অশোক লাহিড়ি। নাম ‘প্রাক্ পূজা সম্মিলন’।
মিঠুন দাবি করলেন, ‘‘আচ্ছা, উদ্বোধন সেরে তো রাত ৯টার মধ্যেই মালদহে ফিরে আসব। আর দার্জিলিং মেল ছাড়বে তো সেই রাত ১২টায়। মাঝে অনেকটা সময়। আমি চাই, মালদহেও একটা বৈঠক রাখুন। নেতাদের সঙ্গে একটু কথা বলব। আর সেই সঙ্গে আলাদা করে কর্মীদের সঙ্গেও যদি বসা যায় কিছুক্ষণের জন্য।’’
সুকান্ত ফের একাধিক ফোনের শেষে বললেন, ‘‘হয়ে যাবে। মালদহ জেলা দফতরেই সবাইকে ডেকে নিচ্ছি। রবিবার আপনি ওখানেই রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনে চলে যেতে পারবেন। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি।’’
এত ক্ষণে মিঠুনের নজর আবার পড়ল আমার দিকে। প্রশ্ন তৈরিই ছিল— রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। বিজেপিতে এসেও ভোটের প্রচার করেছেন। এখন আরও বেশি করে রাজনীতি করতে চাইছেন? মিঠুন একটু থেমে বললেন, ‘‘এ বার আরও বেশি করে লড়াই দেওয়ার কথা ভাবছি। বিধানসভা ভোটের সময়ে ৩৬টা সভা করেছিলাম। মোট ১৩৪টা বিধানসভার প্রার্থীর জন্য প্রচার করেছি। লোকসভা নির্বাচনে কম করেও ৬০দিনের প্রচার করব। গোটা বাংলা ঘুরব।’’
ফোন এল। ভিডিয়ো কল। মিঠুন বললেন, ‘‘আমার একটা ছোট্ট বন্ধু আছে। একটু কথা বলে নিই।’’ কলকাতায় তাঁর সহকারীর ছেলের সঙ্গে নাকি দু’বেলা ফোনে মজা করাটা তাঁর রুটিন। ভিডিয়ো কলটা স্পিকারেই দেওয়া ছিল। নানা এলোমেলো কথার পর ও দিক থেকে আব্দার, ‘‘তুমি আগে ভাল কথা বলো। তার পরে ফোন রাখব।’’ মিঠুন বলছেন, ‘‘এখানে অনেক লোক রয়েছে। ভাল কথা বলা যাবে না। কাল সকালে বলব।’’ নাছোড় শিশুকণ্ঠের আবদার তবু থামে না। এ বার ফোনটা একেবারে মুখের কাছে নিয়ে কিছু একটা বলে রেখে দিলেন মিঠুন।
কী ‘ভাল কথা’? মিঠুন অট্টহাস্য করতে করতে বললেন, ‘‘এ হচ্ছে আমার দারুণ বন্ধু। ভাল কথা মানে আমাকে কয়েকটা বাছাই গালাগাল দিতে হবে। সেটা নাকি ওর শুনতে ভাল লাগে।’’
বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে মিঠুনের মুখে শোনা গিয়েছিল ডায়লগ— ‘‘আমি জলঢোঁড়াও নই। বেলেবোড়াও নই। আমি জাত গোখরো। এক ছোবলে ছবি!’’ লোকসভা ভোটের প্রচারেও কি তেমন ‘ডায়লগ’ শোনা যাবে?
প্রসঙ্গ উঠতেই মিঠুন ক্ষুব্ধ। বললেন, ‘‘আরে মিথ্যা একগাদা প্রচার করল ওরা আমায় নিয়ে!’’ পুরনো দল তৃণমূলের নেতাদের কারও কারও নাম করেই নানা কথা বলে গেলেন। কিন্তু টানা কথা যে বলবেন, তার জো আছে! পর পর তিন জন টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) এলেন। টিকিট পরীক্ষা করতে নয় অবশ্য। নিজস্বী তুলতে। হাসি মুখেই ছবি তুললেন অতীতের ‘হিরো’। কারও মুখে শুনলেন স্কুল পালিয়ে তাঁর ছবি দেখতে গিয়ে বাবার হাতে মার খাওয়ার গল্প। কেউ বললেন, এখনও সুযোগ পেলেই তাঁর ছবি দেখেন। এক রেলকর্মী ঢুকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘স্যর, এসি ঠিক কাজ করছে তো?’’ সম্মতি দিয়ে ফের আড্ডায় ফেরার আগে আরও এক জন সেই একই প্রশ্ন নিয়ে ঢুকতেই কিঞ্চিৎ বিরক্ত মিঠুন। কিন্তু তিনি রেগে গেলে কী হবে, হাতের কাছে ‘মহাগুরু’-কে পেয়ে কে আর ছাড়ে!
মিঠুন আবার সুকান্তের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনায় ফিরে গেলেন। কী করে রাজ্যে যুব সংগঠনকে আরও একটু শক্তিশালী করা যায়, আরও বেশি করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দলে টানা যায় এ সব নিয়ে। ট্রেন তখন ডানকুনি টপকে বর্ধমানের দিকে। মিঠুন জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। খুব আসতাম মামার বাড়িতে। জৌগ্রাম স্টেশনে নেমে অনেকটা হেঁটে যেতে হত মামাবাড়িতে। সেই গ্রামটার নাম কুলীন। দিদিমার কাছে খালি কোলে ওঠার বায়না করতাম। কিন্তু আমায় নিয়ে হাঁটা যায় না কি! একটু কোলে নিতেন। আবার নামিয়ে দিতেন, আবার নিতেন।’’ সেই কথা বলতে বলতেই চলে গেলেন নালিকুলে। বললেন, ‘‘হুগলির নালিকুলে মায়ের এক পিসি থাকতেন। তিনি দৃষ্টিহীন ছিলেন। আমাদের মায়েদের সবাইকে এক মাস করে ওঁর কাছে গিয়ে থাকতে হত। আমিও মায়ের সঙ্গে গিয়ে এক মাস থাকতাম।’’
গ্রাম খুব ভাল লাগে? মিঠুন বললেন, ‘‘লাগে তো! সিনেমায় আসার পরে তো গ্রামে বেশি ঘোরাঘুরি করার সুযোগ হয়নি। বিজেপিতে আসার পরে আবার গ্রাম দেখলাম। মানে কাছ থেকে দেখলাম। লোকসভা নির্বাচনে বেশি করে ঘোরার পরিকল্পনা তো ওই কারণেই।’’
তখন রাত প্রায় ১টা। মিঠুন নিজেই বললেন, ‘‘এ বার খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়া যাক। কাল তো আবার ভোর ৫টায় উঠতে হবে।’’ শনিবার দিনভর বিশ্রাম নিতে পারেননি। টানা কর্মসূচি ছিল। সে সব সেরে ট্রেনে উঠেছিলেন।
মালদহে ট্রেন পৌঁছল ভোর ৫টা ২০ মিনিটে। ঠিক সময়ে। প্রথমে হোটেল হয়ে ১১৫ কিলোমিটার দূরের বালুরঘাট শহরে। বেলা ১১টা থেকে টানা দুপুর ১টা পর্যন্ত একটি লজে দলীয় বৈঠক।
রবিবার বালুরঘাটে ‘চেনা মিঠুন’-এর দেখা পাওয়া গেল না। কথায় কথায় ‘ডায়লগ’ নেই। বিজেপি নেতা, কর্মীদের দিয়ে গেলেন সংগঠন বাড়ানোর পরামর্শ। শহরজুড়ে লাগানো তাঁর পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়া, হোটেল না দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে সোজা কথা, ‘‘ওরা যত করবে, আমাদের শক্তি তত বাড়াতে হবে।’’ সন্ধ্যায় বালুরঘাটের নিউ টাউন পুজো মণ্ডপে কাতারে কাতারে মানুষ। ২০১৯ সালে সাংসদ হওয়ার পর থেকে এই পুজোর উদ্বোধন করে থাকেন সুকান্ত। এ বার তাঁর সঙ্গে মিঠুন। সেখানকার ভিড়েও কোনও ডায়লগ শোনা গেল না। অল্প সময় থেকেই গাড়িতে। ১১৫ কিলোমিটার সড়ক-সফর সেরে মালদহ বিজেপি অফিসে। বৈঠকের প্রস্তুতি গোছানোই ছিল। কিন্তু মিঠুন পৌঁছতে না পৌঁছতেই সব ভণ্ডুল হয়ে গেল। বিরক্ত হলেন মিঠুন। মিনিট ১৫ থেকেই চলে গেলেন হোটেলে। স্থানীয় নেতা ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিলেন। নিজস্বী তোলারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ভিড়ের ঠেলায় হল না। এক নেত্রীর গলায় শোনা গেল আক্ষেপ, ‘‘দূর! আমার ২০০ টাকা খরচটাই জলে গেল!’’
রবিবার রাত সওয়া ১১টা। মালদহ টাউন স্টেশন—
দার্জিলিং মেল ছাড়বে ১১টা ৫৫ মিনিটে। এ বারও কোচ ‘এইচ-১’। কুপ ‘এ’। কালো ট্রাউজার্স আর সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে সেই কালো টুপি আর সাদা চাদর। চোখ-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। প্ল্যাটফর্ম ধরে অনেকটা হেঁটে যেতে হবে কামরায়। নিজস্বীর আবদার থামছে না। কোনও কোনওটা রাখলেও চোখমুখে অনিচ্ছার ভাব। ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, এক দিনে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার টানা ধকলের শেষে ট্রেনে উঠেই শুয়ে পড়বেন। সোমবারও দলের কথা মেনে কিছু উদ্বোধন আছে।
সোমবার ভোর ৬টা। শিয়ালদহ স্টেশন।
ট্রেন থেকে নেমে গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছেন ক্লান্ত মিঠুন। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় যাঁর বয়স আরও দুই বেড়ে ৭৪ হবে। লোকসভা ভোটে তাঁর ৬০ দিনের ব্যস্ত সফরের পরিকল্পনা। ‘জাত গোখরো’র ছোবলে ‘ছবি’ হবে তো!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy