অান্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে, অ্যাকাডেমির সামনে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
ময়দানের বইমেলায় আগে কাউন্টার থাকলেও বিধাননগরের সেন্ট্রাল পার্কে চলতি বছরই প্রথম কাউন্টার খুলেছিল ভারতীয় ডাকঘর। উদ্দেশ্য ছিল, কাউন্টার থেকেই লোকজন যাতে ভিন্ রাজ্যে বা অন্যত্র থাকা আত্মীয়-বন্ধুদের উপহার হিসেবে বই পাঠাতে পারেন। সংস্থার এক কর্মীর কথায়, ‘‘অনেকেই স্পিডপোস্টে, পার্সেলে বই পাঠিয়েছেন। বই উপহার দেওয়ার রীতি কিন্তু ফিরে আসছে।’’
পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের কর্তারা আবার মনে করছেন, মোবাইল থেকে বইয়ের প্রতি ছোটদের মন টেনে আনতে অভিভাবকদেরই বাড়িতে ছোট পাঠাগার তৈরি করতে হবে। সে ইংরেজি বা বাংলা, যে ভাষারই হোক না কেন। ইংরেজি ও বাংলার মধ্যে যে বিরোধ নেই, তা বোঝাতে আগামী বছর দশটি বাংলা ও দশটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের মধ্যে প্রতিযোগিতারও পরিকল্পনা করেছে গিল্ড। বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়ারা ভাল ইংরেজি পড়তে বা লিখতে পারলে এবং ইংরেজি মাধ্যমের পড়ুয়ারা বাংলায় ভাল পড়তে বা লিখতে পারলে তাদের পুরস্কৃত করা হবে। গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশুশেখর দে-র কথায়, ‘‘বাংলা ভাষার জন্য এই আদানপ্রদান খুবই প্রয়োজন। আগে পড়ার অভ্যাসটা ফিরুক, তার পরে না হয় ইংরেজি, বাংলা সাহিত্য নিয়ে ভাবা যাবে।’’
শুধু বাংলা সাহিত্যই নয়, বাংলা গান কত জন শুনছেন, সে প্রশ্নও প্রায়ই ওঠে। গায়িকা লোপামুদ্রা মিত্রের কথায়, ‘‘এই প্রজন্মের একটি গোষ্ঠী আন্তরিক ভাবেই বাংলা গান শুনছে। কিন্তু সেই সংখ্যাটা কম। বেশির ভাগই গানের সঙ্গে কতটা মাথা ঝাঁকাতে পারবে, কতটা নাচতে পারবে তার জন্য গান শুনছে। কারণ, তাদের সামনে এখন অন্য অনেক বিকল্প রয়েছে।’’
যে কোনও ভোগ্যপণ্যের মতো ভাষারও একটি ‘প্ররোচক ধর্ম’ থাকায় তাকে পণ্য হিসেবে ধরাই যায় বলে জানাচ্ছেন ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতির গবেষকদের একাংশ। সেখানে যে প্রশ্নটি অবধারিত ভাবে উঠে আসে তা হল, পণ্য হিসেবে সাহিত্য, গান, সিনেমা বা অন্য যে ক্ষেত্রই হোক না কেন, বাংলা ভাষার মূল্য কত? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অভিজিৎ মজুমদারের উত্তর, ‘‘দেশ-বিদেশের বাঙালির সংখ্যা ধরলে পণ্য হিসেবে বাংলা ভাষা হয়তো উল্লেখযোগ্য জায়গায় থাকবে। কিন্তু সব মিলিয়ে বাংলা ভাষা গোষ্ঠী নির্ভর হওয়ায় ইংরেজির তুলনায় বাংলার আর্থিক মূল্য কমই।’’
তবে বাংলা ভাষাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করতে গেলেও আগে তার ভিত মজবুত করা প্রয়োজন বলে জানাচ্ছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা শম্পা চৌধুরী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ইংরেজি ভাষায় অনেক বিদেশি শব্দ ঢুকেছে, অক্সফোর্ড অভিধানেও সে শব্দ জায়গা করে নিয়েছে, সে জন্য কিন্তু ইংরেজির মর্যাদা কমেনি। অথচ বাংলায় প্রবেশ করা শব্দগুলি এ ভাষার নিজস্ব কাঠামোই পাল্টে দিচ্ছে। এটাই বিপজ্জনক।’’
যে কোনও ভাষার বিস্তারের সঙ্গেই অর্থনীতি জড়িত বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। যেমন কোনও বহুজাতিক সংস্থাকে চিনে নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে গেলে চিনা ভাষাই ব্যবহার করতে হয়, তেমনই কোনও হিন্দি সিনেমাকে দক্ষিণ ভারতে ব্যবসা করতে হলে তাদের ভাষাতেই ‘ডাব’ করতে হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অজিতাভ রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘বিনোদন, ব্যবসা-সহ যে কোনও ধরনের ই-মাধ্যম ও পর্যটনে বাংলা ভাষাকে কতটা তুলে ধরা যাচ্ছে তার সঙ্গে এর পরিসর বিস্তারের বিষয়টি জড়িয়ে। কারণ, অর্থনীতিতে ইংরেজি ভাষা বলা দেশগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের হাত ধরেই দ্রুত ইংরেজি ছড়িয়েছে।’’
বাংলার পরিসর বৃদ্ধির বিষয়টি অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত মেনে নিয়েও কলকাতার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বন্দনা মিশ্র বলছেন, ‘‘এ রাজ্যে ছোটদের অল্প বয়স থেকে বোঝানো হয়, বাংলা পড়ে কিছু হবে না। এই মানসিকতাই মূল সমস্যার কারণ।’’ কবি জয় গোস্বামীও মনে করেন, বাংলাকে গুরুত্বহীন করাটা ভাষার নয়, বরং সামাজিক সমস্যা। জয়ের কথায়, ‘‘কিন্তু এত কিছুর পরেও মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়, বাংলা নিয়ে আবেগ থাকে। যে ক’জন বাংলা ভালবাসে, তাদের দিকেই আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে।’’
শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেই এ প্রজন্ম বাংলা নিয়ে কথা বলে, ফেসবুকে পোস্ট করে এমন অভিযোগ প্রতি বছরই ওঠে। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতেই বাংলায় স্নাতকোত্তরের পড়ুয়া অনুরাধা মিত্রের পাল্টা প্রশ্ন, রোজ কি কেউ নিজের জন্মদিন পালন করেন, রোজ কেক কাটা হয়?
অনুরাধার কথায়, ‘‘শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘তোমার জন্মদিনে কী আর দেব শুধু এই কথাটুকু ছাড়া যে/ কাল থেকে রোজই আমার জন্মদিন!’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাংলা ভাষার জন্মদিন হলে শুধু জন্মদিনেই নয়, ভাষার চর্চা চলতে থাকুক রোজ। এটুকুই শুধু চাইব!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy