ছ’মাসের ব্যবধানে দু’টি ছবি। দু’টি বৈঠক। দু’টি বৈঠকেরই মধ্যমণি তিনি। টেবিলের ও পারে ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা।
২১ অক্টোবর ২০২৪: নবান্নে যখন সেই বৈঠক হচ্ছে, তখন ধর্মতলায় বাঁধা আমরণ অনশনের মঞ্চ। যে মঞ্চ ঘিরে রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। আরজি কর-কাণ্ডে তার চেয়েও বেশি মানুষের ক্ষোভ এবং ক্রোধ পুঞ্জীভূত সরকারের বিরুদ্ধে। তার আগে একাধিক বার সরকারি উদ্যোগ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। তার পরে ওই দিন নবান্নে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মমতা। ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের বৈঠক শেষে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন উঠেছিল। ঘটনাচক্রে, তার পর থেকেই মিইয়ে যেতে থাকে আরজি কর আন্দোলনের ঝাঁজ। যা এখন মিলিয়েই গিয়েছে বলা যায়।
৭ এপ্রিল ২০২৫: প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের পরে সোমবার নেতাজি ইন্ডোরে ‘যোগ্য বঞ্চিত’দের নিয়ে বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসক হিসাবে তো বটেই, ‘দিদি’ হিসাবেও চাকরিহারাদের আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেছেন, ‘‘আমার জীবন থাকতে কোনও যোগ্যের চাকরি যেতে দেব না।’’ কারা অযোগ্য, তাঁদের কেন অযোগ্য বলা হচ্ছে, আদৌ তাঁরা অযোগ্য কি না, তা-ও যে রাজ্য সরকার খতিয়ে দেখবে, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। সন্দেহ নেই, এক লপ্তে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল সরকারের উপর ‘চাপ’ তৈরি করেছে। চাকরিহারাদের ভবিষ্যৎ যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তেমনই তা নিয়ে সরকার-বিরোধিতার ঝাঁজ বাড়াচ্ছে বিরোধীরা। সেই পরিস্থিতিতে মমতা নিজে আবার ময়দানে নেমেছেন। আশ্বাস দিলেন, চাকরি খেতে দেবেন না।
ব্যবধান প্রায় ছ’মাসের। নবান্ন থেকে নেতাজি ইন্ডোর— দু’টি বৈঠকে প্রশাসক মমতাকে মাপজোক করছে বিরোধী শিবির। অনুবীক্ষণের তলায় ফেলছে জনতাও।
বিরোধী দল বিজেপি, সিপিএম বা কংগ্রেসের নেতারা কেউ আনুষ্ঠানিক ভাবে বলছেন, কেউ একান্ত আলোচনায় যে, আরজি কর পরিস্থিতি ছিল এর থেকে অনেক বেশি কঠিন এবং স্পর্শকাতর। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারের কথায়, ‘‘আরজি করের মতো ঘটনা এবং তার ফলে যে নাগরিক আন্দোলন হয়েছিল, তা আমি আমার জীবনে দেখিনি।’’ যদিও শুভঙ্কর বলেছেন, ‘‘আরজি করের ঘটনা এবং দুর্নীতির কারণে চাকরি বাতিল— দুটোই বাংলার ইতিহাসে কলঙ্কজনক ঘটনা।’’ আবার বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘ওঁর (মুখ্যমন্ত্রীর) কাছে কোনওটাই কঠিন নয়, আবার সবটাই কঠিন। কারণ, ওঁর দলটাই উঠে যাবে।’’ বঙ্গ বিজেপির প্রধান মুখপাত্র এ-ও বলছেন যে, ‘‘আরজি কর আন্দোলনে মানুষের আবেগ জড়িয়ে ছিল। আর নিয়োগ দুর্নীতি অনেক প্রলম্বিত। মানুষ তৃণমূলের দুর্নীতি দেখতে দেখতে অসহায় অবস্থার মধ্যে চলে যাচ্ছেন।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অবশ্য মমতার কাছে কোন বৈঠক ‘কঠিনতর’, সে বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ, ‘‘মমতার রাজত্বে বাংলার মানুষের জীবনই কঠিন হয়ে পড়েছে।’’
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘ব্যাপক উন্নয়নের মধ্যে কোনও কোনও সময়ে পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়। তখন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলে, যাঁদের সমস্যা তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বললে তার সমাধান হয়। আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।’’ তবে শাসকদলের নেতারাও মানছেন, আরজি কর পরিস্থিতি মমতার জন্য ছিল অনেক বেশি ‘কঠিন’। পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে চাকরি বাতিল তা নয়। অন্তত এখনও পর্যন্ত।
কী কারণে? একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে শাসক-বিরোধী উভয় শিবিরেরই। প্রথমত, আরজি করের ঘটনা গোটা স্বাস্থ্য প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল। যে দফতর মমতার নিজের হাতে। আর শিক্ষা দফতর সরাসরি মমতার অধীনস্থ নয়। দ্বিতীয়ত, যিনি শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন এই সব কেলেঙ্কারির ‘সিরিজ়’ হয়েছিল, সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখনও জেলবন্দি। দল হিসাবেও তৃণমূল পার্থকে ঝেড়ে ফেলেছে। ফলে মমতার কাছে এর রাজনৈতিক মোকাবিলা করা ততটা কঠিন বলে মনে হচ্ছে না। তৃতীয়ত, আরজি কর-কাণ্ডে যে নাগরিক আন্দোলন এবং মহিলাদের ক্ষোভ প্রথমে ধূমায়িত এবং পরে বিস্ফারিত হয়েছিল, নিয়োগ দুর্নীতিতে এখনও পর্যন্ত তেমন লক্ষ করা যাচ্ছে না। বস্তুত, তৃণমূলের শীর্ষনেতারা মনে করেন, আরজি কর-কাণ্ডে বাংলাদেশের ঘটনার ‘প্রভাব’ পড়েছিল। প্রতিবেশী দেশের নাগরিক আন্দোলনের ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়েছিল এ পার বাংলায়। নিয়োগ দুর্নীতিতে সেই অবকাশ নেই।
তবে অন্য ব্যাখ্যাও রয়েছে। শাসকদলেরই এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘আরজি কর, চাকরি বাতিল— কোনও ঘটনাকে পৃথক ভাবে না দেখে সার্বিক ভাবে দেখা উচিত। দু’টি ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক স্তরে দুর্বলতার ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। সামগ্রিক ভাবে ক্ষোভের ব্যাপ্তি বা প্রকার যা-ই হোক, তা সরকারের বিরুদ্ধে।’’ ঘটনাপরম্পরা বলছে, গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর এক বছরের মধ্যে মমতাকে দু’টি ঘটনায় ‘চাপে’ পড়তে হল। প্রথমটি আরজি কর, দ্বিতীয়টি প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল। প্রথমটি প্রশাসক মমতা সামলে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি?