সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
সোমনাথবাবুকে বাগডোগরা থেকে ডুয়ার্সে নিয়ে আসতে সাধের মার্সিডিজ গাড়িটি নিয়ে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন তিনি। পরে সোমনাথবাবুর কলকাতার লেক রোডের বাড়িতে গিয়ে যে আপ্যায়ন পেয়েছিলেন তাও ভোলার নয়। বর্ষীয়ান সাংসদ তথা লোকসভার প্রাক্তন স্পীকারের প্রয়াণের পরে এ ভাবেই তাঁর স্মৃতির ভারে জড়িয়ে পড়লেন মালবাজার তথা উত্তরবঙ্গের বর্ষীয়ান শিল্পপতি নীলমণি রায়।
তবে রাজনীতিক সোমনাথবাবুকে নয়, নীলমণিবাবু আইনজীবী সোমনাথবাবুর মক্কেল হিসেবেই তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন। কঠিন মামলায় নিশ্চিত হার যেখানে অপেক্ষা করছে বলে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, সেখান থেকেই মামলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সোমনাথবাবু, এমনটাই জানালেন নীলমণিবাবু। কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে তিনি বললেন, ‘‘অনেকটাই এলাম, দেখলাম, জয় করলামের ভঙ্গিতে যেন তিনি মামলা জিতে কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে এলেন।’’
‘‘সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের দিন খুবই অস্থির হয়ে উঠেছিল মন,’’ এ কথা বলতে বলতে, পুরনো দিনে যেন ফিরে গেলেন নীলমণিবাবু। স্মৃতিকথায় বছর ২৪ আগের সেই দিনগুলিই যেন ভেসে উঠছে তাঁর চোখের সামনে।
নীলমণিবাবু গত শতকের আশির দশকে সুগন্ধি দার্জিলিং চায়ের একটি বাগান কিনেছিলেন। ‘মিশন হিল’ নামের সেই চা বাগান কেনার সময় থেকেই মালিকানা নিয়ে নানা জটিলতা ছিল বলে জানালেন নীলমণিবাবু। তাঁর আইনজীবীরা নথিপত্র দেখে মামলা লড়ে বাগানের মালিকানা মিলতে পারে বলে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। নব্বই দশকের শুরু থেকেই মামলার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। কলকাতা হাইকোর্টে ’৯১ সাল থেকে মামলা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মামলায় প্রতিপক্ষের কাছে কোনওভাবেই এঁটে উঠতে পারছিলেন না নীলমণিবাবু। জেদ চেপে যায় এক সময়। তাই এর শেষ দেখতে যখন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি, তখনই উকিল সোমনাথবাবুর নাম উঠে আসে।
বিপক্ষে সোলি সোরাবজির মতো সেই আমলের ডাকসাইটে দুঁদে আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণে রাজি হয়ে যান সোমনাথবাবু। নীলমণিবাবু জানালেন, কলকাতার একটি বিখ্যাত আইনি সংস্থা তাঁর হয়ে হাইকোর্টে মামলাটি লড়ছিলেন। সুপ্রিমকোর্টে মামলা যখন তাঁরা নিয়ে গেলেন, সেই সংস্থাই সোমনাথবাবুর নাম প্রস্তাব করেছিল।
নীলমণিবাবুর কথায় “সোমনাথ বাবুর নাম শুনেই আমি আশ্বস্ত হয়েছিলাম, পারলে উনিই পারবেন এমনটাই আমার বিশ্বাস ছিল।সোমনাথবাবু মাত্র তিন মাসে সেই মামলা জিতিয়ে এনেছিলেন। মামলা জেতার পর দিনই সোজা বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামেন তিনি।’’ নীলমণিবাবু স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘‘সেটা ছিল অক্টোবর মাস। আমার গাড়িতে করে উনি ডুয়ার্সে আসেন, এর পর কথা বার্তা বলে আবার সেদিনই ফিরে যান।” স্বভাবসিদ্ধ ব্যারিটন আওয়াজে তিনি নীলমণিবাবুকে বলেছিলেন “বাগানটা এবার ভাল করে চালাও”।
সোমনাথবাবুর সেদিনের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন নীলমণি রায়। এর পর কলকাতার লেক রোডে সোমনাথবাবুর বাড়িতেও গিয়েছিলেন নীলমণিবাবু। সে দিনের সেই স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে তিনি বলেন, “একেবারে খাঁটি বাঙালি বলতে আমরা যা বুঝি তাই ছিলেন সোমনাথবাবু। আমাকে বাড়িতে বসিয়ে আপ্যায়ন করে, যে ভাবে সেদিন তিনি মিষ্টি খাইয়েছিলেন, তা কোনও দিন ভুলব না।”
সোমনাথবাবুর প্রয়াণের খবর পাওয়ার পর থেকেই, ৮৩ বছরের এই শিল্পপতি শোকে বেশ কিছুটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে রয়েছেন। স্মৃতির ভারে কাতর নীলমণিবাবু বললেন, “কালের নিয়মেই এই মৃত্যু কিন্তু এই ধরনের মুল্যবোধের মানুষগুলো চলে গেলে সমাজটা টিঁকে থাকবে তো? সেটা ভেবেই বড় ভয় হয়।” গলায় আক্ষেপ, আর চোখের স্মৃতিমেদুরতায় নীলমণিবাবুর গলা কেঁপে ওঠে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy