বৈদ্যপাড়ায় মদুসূদন গুপ্ত বাড়ি এখন যে চেহারায়।
ভদ্রপল্লী বৈদ্যবাটি/
পণ্ডিতের বাস/
শাস্ত্র আপালন যথা/
হয় বারোমাস
বিশিষ্ট কবি, নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র বৈদ্যবাটিকে এ ভাবেই তাঁর লেখনিতে স্থান দিয়েছিলেন।
বস্তুত গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে ইতিহাসের খামতি নেই। গঙ্গার পাড় ধরে উত্তরপাড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া উকিঁ দিলেই দেখা মেলে অতীতের বহু নিদর্শন। কোথাও তা অবহেলায় অনাদরে, কোথাও আবার ক্ষীণ হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য চেষ্টা। গোটা হুগলি হুগলি জেলার ইতিহাসের পাতা ওল্টালে এমন জায়গা মিলবে না যেখানে প্রত্ন-নিদর্শন নেই। কোথাও কোথাও কালের নিয়মে তার অস্তিত্ব মুছে গেলেও থেকে নিশ্চিত ঠাঁই পেয়েছে অক্ষরের আঁচড়ে।
১৮০০ শতকে খাঞ্জা খান মুঘল আমলের শেষ ফৌজদার। ফৌজদার অর্থাত্ খাজনা তুলতেন। তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি রাজাদের চেয়ে কিছু কম ছিল না। এক সময় দিনেমারদের দখলদারি ছিল বৈদ্যবাটি আর ভদ্রেশ্বরের বিস্তীর্ণ এলাকায়। কথিত আছে টেকচাঁদ ঠাকুর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লিখেছিলেন এই শহরেই। হুগলির ইতিহাস নিয়ে গবেষণারত সপ্তর্ষী বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, “চৈতন্য মহাপ্রভু এক সময় নিমাইতীর্থ ঘাট এলাকায় কিছুদিন থেকেছিলেন।” পরবর্তী সময়ে বিশিষ্ট শল্য চিকিত্সক মধুসূদন গুপ্তর বাস এ শহরের খ্যাতি আরও বাড়িয়ে দেয়।
নিমাইতীর্থ ঘাটকে যেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, তেমনই শ্রীচৈতন্যকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে আছে গল্পকথা। আর সে সব স্মরণ করেই বর্তমানের প্রবীণদের আপেক্ষ, “বৈদ্যবাটি, শেওড়াফুলির অতীত যে উজ্বল, বর্তমানের প্রেক্ষিতে তা বোঝা ভার। অতীতের সেই উজ্বলতার আলো থেকে বঞ্চিতই থেকে গিয়েছে বর্তমান প্রজন্ম বা বলা ভাল সেই আলো আর পৌঁছয়নি এ কালে।” এক অধ্যাপিকা তো সরাসরি খেদোক্তি, “পৌঁছয়নি কেন? আজকের বাচ্চারা তো যথেষ্ট পড়াশোনায় করে। তাঁদের কাছে এলাকার ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার দায় তো আমাদেরই ছিল। কিন্তু যেখানে কেউ তার দায় নেন না, সেখানে এই জল-হাওয়ায় মানুষ হয়ে এলাকবাসী হিসেবে নিজের দায় একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারি না।”
আজও অবিকৃত ফলক।
দায় ঝেড়ে ফেলার প্রশ্নে কিন্তু মধুসূদন গুপ্তর নাম বৈদ্যবাটিতে সর্বাগ্রে আসে। ইংরেজ আমলে তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি যিনি ভারতে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ (ময়নাতদন্ত) করেছিলেন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি। ১৮৩৬ সালে তিনি প্রথম একটি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করেন। তাঁর সম্মানে সেই আমলে ২১ বার তোপধ্বনি হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকের নির্দেশে। মধুসূদনবাবুর নামে রাস্তা রয়েছে বৈদ্যবাটিতে।
বর্তমান প্রজন্মের সুজিত রায় সম্পর্কে গুপ্ত পরিবারের ভগনে। তাঁর কথায়, “স্থানীয় বিজ্ঞান মঞ্চের কিছু সেমিনার ছাড়া সে ভাবে বৈদ্যবাটির মানুষের জন্য এখানে কোনও তথ্য মেলে না। ওঁর সম্পর্কে যে টুকু তথ্য রয়েছে আছে তা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। আমরা জানি আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানে ওঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি শব ব্যবচ্ছেদ বিজ্ঞান রপ্ত করে ব্রিটিশদের পর্যন্ত তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।” জানা গিয়েছে, মধুসূদনবাবু ইংরাজি থেকে অনেক বই চিকিত্সা বিজ্ঞানের বাঙালি ছাত্রদের সুবিধার জন্য বাংলায় অনুবাদ পর্যন্ত করেছিলেন। তবে সে সব নিয়ে তাঁর আত্মীয় স্বজন বা স্থানীয় প্রশাসন কোনও তথ্য দিতে পারেনি।
শেওড়াফুলি এক প্রবীণ বাসিন্দার আপেক্ষ, “৬০০ বছরের পুরনো শহর এই বৈদ্যবাটি, শেওড়াফুলি এলাকা। এখানে ইতিউতি ছড়িয়ে আছে নানা ইতিহাস। সবই কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারকে করতে হবে কেন? স্থানীয় পুরসভা একটা সংগ্রহশালা করতে পারল না? টাকা চাইলে অনেকেই এগিয়ে আসতেন। অথচ ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে চটুল গানের আসর বসানো হচ্ছে।”
অভিযোগ অস্বীকার করেননি বৈদ্যবাটি পুরসভার চেয়ারম্যান অজয়প্রতাপ সিংহ। তিনি বলেন, “ওটা পঞ্চাশ নয়, মেরেকেটে ৫ লক্ষ টাকার একটা অনুষ্ঠান এলাকার তরুণদের দাবিতে আয়োজন করা হয়েছিল। তবে আমরা মধুসূদনবাবুর আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা আর্কাইভ (সংগ্রহশালা) করতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের তরফে কোনও আগ্রহ এ পর্যন্ত দেখা যায়নি। তবে ওঁর বাড়িটিকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে সংগ্রহশালা করতে আমরা তৈরি।”
সংগ্রহশালা হবে কি না তা সময়ই বলবে। তবে দিনরাত রাজনীতির চর্চার বাড়বাড়ন্তে শহরের ইতিহাস নিয়ে চর্চা যে ক্রমশ শিকেয় উঠছে সে বিষয়ে দ্বিমতহীন বৈদ্যবাটির অধিকাংশ মানুষই। তাঁদের ভাষায়, ‘শহরের উজ্জ্বল অতীত বর্তমান প্রজন্মের হাতে বড়ই ম্লান’।
(শেষ)
—নিজস্ব চিত্র।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর বৈদ্যবাটি’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ,
জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy