Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

তাঁত ছেড়ে নতুন পরিচয় খুঁজছে ধনেখালি

এখানে সব সময়েই হাজার শাড়ির মেলা। তাঁত, বালুচরী, তসর— যেমন বহর, তেমন বৈচিত্র্য আর রং। তবে, সব ছাপিয়ে কদর যেন তাঁতের শাড়িরই বেশি। এখানকার কারিগররা নানা সুতোর নিপুণ বুননে এই শাড়িকে আলাদা মাত্রা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁতিদের জীবনে রং কোথায়?

তাঁতের শাড়ি তৈরির কাজ চলছে।

তাঁতের শাড়ি তৈরির কাজ চলছে।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
ধনেখালি শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৫ ০২:১৬
Share: Save:

এখানে সব সময়েই হাজার শাড়ির মেলা।

তাঁত, বালুচরী, তসর— যেমন বহর, তেমন বৈচিত্র্য আর রং। তবে, সব ছাপিয়ে কদর যেন তাঁতের শাড়িরই বেশি। এখানকার কারিগররা নানা সুতোর নিপুণ বুননে এই শাড়িকে আলাদা মাত্রা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁতিদের জীবনে রং কোথায়?

এ-ও সেই প্রদীপের নীচে অন্ধকারেই পুরনো কাহিনি। সময় পাল্টেছে। কিন্তু ধনেখালির তাঁতিদের এবং শাড়ি শিল্পে সে ভাবে কোনও বদল আসেনি। প্রায় রোজই এই শিল্প ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন কেউ না কেউ। মুখে ফিরিয়েছে নয়া প্রজন্ম।

ধনেখালি আর মামুদপুর— পাশাপাশি দু’টি এলাকাকে কেন্দ্র করে এই তাঁত-মহল্লায় মোট চারটি সমবায় রয়েছে তাঁতিদের। এক সময় এই সব সমবায়ের ছাতার নীচে প্রতিটিতে চারশোরও বেশি তাঁতি ছিলেন। তাঁতিরা তাঁদের তৈরি শাড়ি সমবায়ের মাধ্যমেই সাধারণত বিক্রি করেন। সমবায় থেকে তাঁতিদের সুতো এবং কাপড় তৈরির অন্য সামগ্রী সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এখন ওই সব সমবায়ে তাঁতির সংখ্যা প্রতিদিন কমছে। পেশায় নতুন মুখ আর আসছে না। যাঁরা আছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ ছেড়ে দিচ্ছেন। ফলে, এক-একটি সমবায়ে তাঁতির সংখ্যা কমে দু’শো-আড়াইশোতে এসে ঠেকেছে। তাঁতি-মহল্লায় এখন সে ভাবে যেন আর জেল্লা নেই!

কারণ, খেটেও আর সে ভাবে বাজারের সাপেক্ষে তাঁরা মজুরি পাচ্ছেন না, এমনটাই বলছেন তাঁতিরা। তাঁদের দাবি, আগে একটি শাড়ি বুনে ২৫ টাকা মজুরি পেলে তাতে সংসারের খরচ পোষানো যেত। কিন্তু এখন মজুরি ১০০ টাকা হওয়া সত্ত্বেও সংসার চালানো কঠিন হচ্ছে। মামুদপুর রাসতলায় তাঁতি বিশ্বনাথ ভড় বলেন, ‘‘এখন ১০০ দিনের কাজে এক জন শ্রমিক যে মজুরি পান, তার থেকে তাঁতিরা কম টাকা পান। আর আমরা আশা করব নতুন ছেলেরা এই শিল্পে আসবে! লেখাপড়া শিখে এই কাজে কেউ আসে না কি?’’ নয়া প্রযুক্তি এলে উৎপাদন বাড়বে এবং সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে বলে মনে করছেন তাঁতিতদের একাংশ।

চলছে বিকিকিনি।

তাঁতিদের মজুরি দেয় সমবায়গুলি। সমবায়গুলির বক্তব্য, তারা তাঁতিদের বেশি মজুরি দিলে তাতে শাড়ির দাম বাড়বে। চাহিদায় তার প্রভাব পড়তে পারে। তাই সব সময় তাঁতিদের দাবিমতো মজুরি দেওয়া যায় না। তা ছাড়া, আগের নানা সুবিধা এখন মেলে না। এক সময় সুতো কিনলে এনএইচডিসি (ন্যাশনাল হ্যান্ডলুম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) দামের উপর ১০ শতাংশ ছাড় দিত। বর্তমানে সে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাঁচামালের মানও নিম্নমুখী। শাড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে সরকারি নানা শর্তও চাপানো হচ্ছে বলে তাঁদের অভিযোগ। ফলে, ধুঁকছে সমবায়গুলিও।

‘ধনেখালি ইউনিয়ন তাঁতশিল্পী সমবায় সমিতি’র কর্তা হরিপদ নন্দন বলেন, ‘‘একটা শাড়ি বুনে শিল্পীরা গড়ে প্রতিদিন ১০০ টাকা পান। এই টাকায় বর্তমান বাজারে কারও পেট চলে? কেন এই পরিস্থিতিতে লোকে এই পেশায় আসবে? আমাদের ঘরের ছেলেদের আর কোনও আগ্রহ নেই এই পেশায়।’’ আর একটি সমবায়ের ম্যানেজার ভরতকুমার দাস বলেন,‘‘ভাববে কে? নতুন মুখ। শিক্ষিত ছেলেরা। তাঁরাই তো আজ মুখ ফিরিয়ে এই শিল্পের প্রতি। তার ফলে ধনেখালির তাঁত মহল্লা এখন যেন তার কৌলিন্য হারাতে বসেছে।’’

তাঁতশিল্পীরা হতাশার কথা বললেও স্থানীয় বিধায়ক অসীমা পাত্র অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেন,‘‘তাঁতের সঠিক বিপণনের জন্য ধনেখালি বাসস্ট্যান্ডের কাছে জমি দেখা হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হবে তাঁতের হাট। তাতে তাঁতিদের সুবিধা হবে। উপার্জনও বাড়বে।’’

স্থানীয় বিধায়ক সরকারি প্রকল্পের কথা শোনালেও ধনেখালির বিশিষ্ট শিল্পপতি অরিজিৎ সাহা অবশ্য শুনিয়েছেন এই শিল্প নিয়ে তাঁর অন্য ভাবনার কথা। তিনি বলেন, ‘‘এখানকার শাড়ির চাহিদার কোনও ঘাটতি নেই। এখান থেকে দক্ষিণ ভারতে শাড়ি যাচ্ছে নিয়মিত। এখন চাই এই শিল্পের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে অন্য ভাবনা। চাই প্রযুক্তিগত নতুন দিশা। আধুনিকতা ছাড়া কোনও শিল্প বাঁচে না।’’

সুদিন আসার অপেক্ষায় নয়া প্রজন্মের তাঁতিরা।

(চলবে)

ছবি: দীপঙ্কর দে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE