ফুটবলার সুপ্রিয় পণ্ডিতের সঙ্গে গর্বিত বাবা-মা। —নিজস্ব চিত্র।
কেরলকে হারিয়ে বাংলা যখন ৩৩তম সন্তোষ ট্রফি জিতল, হুগলির প্রৌঢ়ের চোখে তখন জল! স্বামীকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি প্রৌঢ়া স্ত্রী-ও। গরিবের সংসার। ফুটবল খেলা নিয়ে মাতামাতির জন্য যে ছেলেকে বকুনি দিয়েছেন, তাঁর জন্যই আজ গর্বিত হুগলির দম্পতি! সন্তোষজয়ী বাংলা দলের সদস্য সুপ্রিয় পণ্ডিতের বাবা কাশীনাথ পণ্ডিত অন্যের জমিতে চাষাবাদ করতেন। ছেলেকে খেলার জন্য বুটও কিনে দিতে পারেননি। বলছেন সেই খেদের কথাও।
২০২৪ সাল বাংলা ফুটবলের জন্য বিশেষ বছর। সুপার কাপ, আইএসএল শিল্ড, আই-লিগ, আই-লিগ তৃতীয় ডিভিশনের পর বছরের শেষে সন্তোষ ট্রফি ঘরে এনেছে বাংলার ফুটবল দল। গত ৩১ ডিসেম্বর কেরলকে ১-০ গোলে হারানো ছিল হুগলির সুপ্রিয়দের দলগত প্রয়াস। কিন্তু দারিদ্রের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াইটা কেবল তাঁরই!
হুগলির নালিকুলের বন্দিপুর গ্রামের বাসিন্দা সুপ্রিয়। এলাকার সকলে তাঁকে চেনে বাবাই নামে। সুপ্রিয়ের বাবা কাশীনাথ ভাগচাষি। মা কৃষ্ণা সংসার সামলান। ২৮ বছরের সুপ্রিয় বাড়ি ফিরতেই প্রতিবেশী এবং পরিচিতদের ভিড় ছোট্ট বাড়িটিতে। এত মানুষের শুভেচ্ছা এবং ভালবাসায় আপ্লুত এবং গর্বিত সুপ্রিয়ের বাবা। তিনি বলেন, ‘‘অন্যের জমিতে চাষ করে যা উপার্জন হত, তাতে সংসার টানা কঠিন ছিল। ছেলে ফুটবল খেলে বড় নাম করবে, এ ছিল আমার কাছে দিবাস্বপ্নের মতো।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘টাকার অভাবে ছেলেকে সামান্য এক জোড়া বুটও কিনে দিতে পারিনি। খেলার জন্য ওকে বকাবকি করতাম। চেয়েছিলাম পড়াশোনা করে একটি চাকরি করুক।’’
কিন্তু ছোট থেকে সুপ্রিয়ের ফুটবল-প্রীতি। বাবা-মায়ের বকাবকি, শাসন সত্ত্বেও খেলা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। ফুটবলই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ছোট-বড় টুর্নামেন্টে চুটিয়ে খেলেছেন। দ্বাদশ শ্রেণিতেই পড়াশোনার ইতি। তখন থেকে ফুটবলের মাঠে আরও বেশি করে ঝাঁপিয়েছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মায়ের ভাবনাও বদলেছে। এখন তাঁরাই সুপ্রিয়ের অন্যতম সমর্থক। ছেলে খেলতে গিয়ে কোথাও চোট-আঘাত পেলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে প্রৌঢ় বাবার। কেরলকে হারিয়ে বাংলা সন্তোষ ট্রফি জেতার খবরে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠেছেন বাড়িতে বসে। তবে ছেলেকে ছোটবেলায় বুট কিনে দিতে না-পারার কথা মনে পড়লে এখনও অনুতাপ হয় কাশীনাথের। তিনি বলেন, ‘‘ছেলের জন্য বুট কেনার পয়সা ছিল না। পড়ানোর জন্য যে বই কিনে দেব, সেই সামর্থ্যও ছিল না। অন্যের জমি চাষ করতাম। অনেক বকাবকি করেছি ছেলেকে। আজ ও অনেক বড় হয়েছে। এখন নিজেকে প্রশ্ন করি, কেন ওকে বকতাম!’’
ডিফেন্সে খেলায় সুপ্রিয়ের অবশ্য কোনও ক্ষোভ নেই। সন্তোষ ট্রফি জিতে আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা দলের সদস্যদের জন্য চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। পাড়ার মাঠ থেকে বৈদ্যবাটি কৃষ্টিচক্র হয়ে কলকাতার রেনবো, ভবানীপুর, পিয়ারলেস দলে খেলেছেন তিনি। এখন ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাবের সদস্য সুপ্রিয়ের কথায়, ‘‘কষ্ট করে বাবা মানুষ করেছেন। আর এ বার সন্তোষ ট্রফিতে কঠিন কঠিন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে। কাশ্মীর, রাজস্থান, তেলঙ্গানার মতো কঠিন টিম ছিল। সেমিফাইনালের লড়াই কঠিন ছিল। তবে প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আমরাও ছাড়ার পাত্র ছিলাম না। অধিনায়ক চাকু মান্ডি সর্বদা সাহস জুগিয়েছেন। প্রয়োজনে গোলের জন্য বল বাড়িয়েছি, আবার ডিফেন্সে গিয়ে বল আটকেছি।’’ বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে একটা চাকরি করুক। সেটাও সম্ভব হচ্ছে। সুপ্রিয় বলেন, ‘‘বাংলা দলের প্রত্যেক সদস্যের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাকরির ঘোষণা করেছেন। এ জন্য তাঁর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।’’
এখন ভারতীয় দলে নিয়মিত ভাবে খেলার লক্ষ্যে দৌড়চ্ছেন ডিফেন্ডার সুপ্রিয়। ছেলের সাফল্য নিয়ে মা কৃষ্ণার মন্তব্য, ‘‘অনেক মেরেছি, বকেছি। তবু খেলা ছাড়েনি। ওর বাবারও ইচ্ছা ছিল না। এখন ছেলে অনেক ভাল জায়গায় পৌঁছেছে, সেটা দেখেই আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। প্রার্থনা করি, ও আরও বড় হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy