গ্রামের পথে ও মাঠে-ঘাটে নাকি নিখোঁজ শিশুর ‘আত্মা’ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই তার পারলৌকিক কাজ না করলে সকলের ক্ষতি হবে। মায়ের কাছে এসে তাঁর হারিয়ে যাওয়া সন্তান সম্পর্কে প্রায়ই এ সব কথা বলতেন প্রতিবেশীরা। ছেলের পথ চেয়ে অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। হয়তো কোনও দিন তার খোঁজ মিলবে। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের চাপে পড়ে খানিকটা বাধ্য হয়েই এক দশক আগে হারানো সন্তানের পিণ্ডদান করেন মা।
শনিবার হাওড়ার হাসপাতালে বহু বছর বাদে সেই ছেলের বুকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে ক্ষমা চাইছিলেন মা। যদিও মায়ের কথা বা কান্না
হয়তো আদৌ বুঝতে পারেননি স্মৃতিভ্রংশতায় আক্রান্ত ২১-২২ বছরের সেই তরুণ। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে হাওড়া হাসপাতালেই ভর্তি আছেন তিনি, ভবঘুরে পরিচয়ে। হাওড়া পুলিশের উদ্যোগে এবং হ্যাম রেডিয়োর তৎপরতায় বিহারের ভাগলপুরের ঝাজি দেবী অবশেষে খুঁজে পেয়েছেন ১৫ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলে সাগর
মণ্ডলকে। এ দিন ছেলেকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারেননি তিনি। সাগরের বুকে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে বার বার বলতে থাকেন, ‘‘আমাকে ক্ষমা করে দিস। লোকের কথা শুনে তুই মারা গেছিস ভেবে আমি তোর পিণ্ডদান করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দে।’’
এক দশক আগে জীবিত একটি শিশুর পিণ্ডদানের ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন সেখানকার ভানসিপুর ব্লকের মহেশপুর গ্রামের মুখিয়া রেখা দেবী। তবে, সাগরের খোঁজ মেলায় তাঁরাও খুশি। এ দিনই বিহার থেকে সাগরের কাছে ঝাজিকে নিয়ে আসেন গ্রামের লোকজন। তাঁরা জানান, গ্রামের মানুষের ভুল ধারণার জেরেই ঝাজি এক প্রকার বাধ্য হন পিণ্ডদান করতে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগবিশ্বাস জানান, হাওড়া পুলিশ তাঁদের ওই যুবকের কথা জানায়। তার পরে অনেক খুঁজে বিহারের ভোজপুর জেলায় সাগরের মায়ের সন্ধান মেলে।
ঝাজির পরিচিতেরা জানাচ্ছেন, সাগরের বাবা দিনমজুর ছিলেন। তিনি খেতে কাজ করার সময়ে বজ্রাঘাতে মারা যান। তার পরে দুই সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার
লড়াই শুরু করেন ঝাজি। নিজেই
খেতে কাজ করতেন। কাছাকাছি কোথাও গামছা দিয়ে দোলনা
বানিয়ে শুইয়ে রাখতেন সাগরকে। সেই ছেলে একটু বড় হওয়ার পরে সাত বছর বয়সে এক দিন
নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তার আর সন্ধান মেলেনি।
এ ভাবেই কিছু সময় কাটার পরে গ্রামে রটে যায়, সাগর মৃত। তার
‘আত্মা’ নাকি গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে দেখা দিয়ে মিলিয়ে
যায়। তাই ঝাজির উপরে চাপ
বাড়তে থাকে স্বামীর সঙ্গে
ছেলেরও পিণ্ডদান করার জন্য। শেষ পর্যন্ত গয়ায় গিয়ে স্বামীর সঙ্গে
নিখোঁজ ছেলেরও পিণ্ডদান করেন ঝাজি।
অম্বরীশ বলেন, ‘‘ধান কেটে মহাজনের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার পরে খেতে ফিরে ঝাজি দেখেছিলেন, ছেলে নিখোঁজ। হাওড়া হাসপাতাল আমাদের জানিয়েছিল, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে জখম সাগরকে তারা উদ্ধার করে। তার পর থেকেই সাগর সেখানেই রয়েছেন। তবে সাগরের চিকিৎসা প্রয়োজন। স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছেন তিনি।’’
এ দিন হাওড়া হাসপাতালে কান্নাকাটির পরে মুখে হাসি ফেরে ঝাজির। তিনি বলেন, ‘‘ছেলে
যে বেঁচে রয়েছে, এটাই তো ভাবিনি এত বছর ধরে। গ্রামের মুখিয়া
আমাকে খবর দিয়েছিলেন।
আমরা খুব গরিব। অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছি। ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে
ভাত খাওয়াব।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)