Advertisement
১০ জানুয়ারি ২০২৫
Cyber Fraud

কিউআর কোডে ডিজিটাল ফাঁদ! সাদাকালো সঙ্কেত না বুঝে স্ক্যান করলেই বিপদ, কী ভাবে কী কী হতে পারে

কিউআর কোড। বর্গাকার সাদাকালো সাঙ্কেতিক একটি ছবি। অনলাইনে আর্থিক লেনদেনের জন্য যা অপরিহার্য। তারই ফাঁকফোকরে গজিয়ে উঠছে প্রতারণার ফাঁদ। সময় থাকতে যা চিনে নেওয়া জরুরি। আজ প্রথম কিস্তি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ। গ্রাফিক সহায়তা: এআই।

অঙ্গীরা চন্দ
শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:৫৭
Share: Save:

ঘটনা ১: দুপুর প্রায় দেড়টা। কসবার রাজডাঙায় একটি বাড়িতে আচমকা বেজে উঠল কলিং বেল। দরজা খুলে এক ডেলিভারি বয়কে দেখতে পেলেন তরুণী গৃহবধূ। পরনে জনপ্রিয় খাদ্য সরবরাহকারী সংস্থার পোশাক। অতঃপর যা কথোপকথন হল—

কিন্তু আমি তো এখন কোনও খাবার অর্ডার করিনি!

—না ম্যাডাম, আপনি কি গতকাল রাত ৮টা নাগাদ বিরিয়ানি অর্ডার করেছিলেন?

হ্যাঁ। কেন?

—তার আগে বুধবার রাতে পিৎজ়াও অর্ডার করেছিলেন। তাই তো?

করেছিলাম।

—আপনার জন্য আমাদের কোম্পানি একটা ভাল অফার দিচ্ছে।

পকেট থেকে ছোট্ট কাগজের টুকরো বার করে বিস্মিত বধূর দিকে এগিয়ে দিলেন সেই ডেলিভারি বয়। তাতে রয়েছে সংস্থার নাম এবং কিউআর কোড। বললেন, ‘‘এই কুপনটা আপনি রাখুন। পরের বার যখন খাবার অর্ডার করবেন, তখন এই কুপনের কিউআর কোড স্ক্যান করলে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ।’’

কুপন হাতে পাওয়ার পর আর তর সইছিল না বধূর। সে দিন বিকেলেই আবার অ্যাপ খুলে খাবারের বরাত দিতে বসেছিলেন তিনি। অবধারিত ভাবে স্ক্যান করেছিলেন সেই বিশেষ কুপনের বিশেষ কিউআর কোড। আরও বিস্মিত হয়ে দেখলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে গিয়েছে ৫০০ টাকা!

ঘটনা ২: হুগলির বাসিন্দা এক বেসরকারি সংস্থার কর্মীর ফোনে এক সন্ধ্যায় আচমকা একটি মেসেজ ঢুকেছিল। যে শব্দ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নগদ অর্থ জমা পড়ার সঙ্কেত বহন করে। ফোন তুলে দেখেছিলেন, অ্যাকাউন্টে আট হাজার টাকা ঢুকেছে। কে পাঠিয়েছেন, কেন পাঠিয়েছেন কিছুই বোঝেননি। কোথাও ওই টাকা তাঁর পাওনা ছিল বলেও মনে করতে পারছিলেন না। ভাবতে ভাবতেই ফোন বাজল। অচেনা নম্বর। ভেসে এল অচেনা কণ্ঠ, ‘‘দাদা, আপনার ফোনে কি এইমাত্র আট হাজার টাকা ঢুকেছে?’’ ঢুকেছে, জানানোর পর সেই অপরিচিত কণ্ঠ নিজের নাম জানিয়ে বলল, ‘‘এক বন্ধুকে টাকা পাঠাতে গিয়ে আপনার নম্বরে টাকাটা চলে গিয়েছে। দুটো ফোন নম্বর অনেকটা একই রকম আসলে। দয়া করে আমাকে টাকাটা ফেরত দিন। খুব বিপদে পড়ে গিয়েছি।’’

বেসরকারি সংস্থার কর্মী খানিক আশ্বস্ত হন। টাকার উৎস জানা গিয়েছে। যে নম্বর থেকে ফোন এসেছে, সেখানেই তা হলে টাকা ফেরত পাঠাতে পারবেন। ফোনকারী অবশ্য তা বললেন না। বললেন, ‘‘আমি আপনাকে একটা কিউআর কোড পাঠাচ্ছি। প্লিজ় সেখানে টাকাটা দিয়ে দিন।’’

অচেনা যুবকের পাঠানো কিউআর কোড ব্যবহার করে আট হাজার টাকা ফেরত দিয়েছিলেন হুগলির বাসিন্দা যুবক। কিন্তু দেখেন, তার পর তাঁর ফোন বার্তা পাঠিয়েছে, তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে পর পর তিন বার আরও আট হাজার টাকা করে কেটে গিয়েছে। কয়েক মুহূর্তে বেরিয়ে গিয়েছে ২৪ হাজার টাকা! কী থেকে কী হল, এখনও বুঝে উঠতে পারেননি তিনি।

কিউআর কোড। বর্গাকার সাদাকালো সাঙ্কেতিক একটি ছবি। হাটেবাজারে, শপিং মলে কিংবা ঘরে বসে অনলাইন কেনাকাটায় ওই কোড বা সঙ্কেতের ‘একচেটিয়া রাজত্ব’। ডিজিটাল মাধ্যমে যে কোনও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কিউআর কোড এখন অপরিহার্য। পাঁচ টাকা হোক বা পাঁচ হাজার টাকা, দোকানে গিয়ে নগদ আর বার করতে চান না অনেকেই। মোবাইলের সংশ্লিষ্ট অ্যাপ খুলে দোকানের কিউআর কোড স্ক্যান করেই টাকা দিয়ে দেন। সময় বাঁচে, পরিশ্রমও কমে। ফলে দিন দিন কিউআর কোডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছে সাদাকালো সঙ্কেতে ভরা বর্গক্ষেত্র। আর তার ফাঁকফোকরে গজিয়ে উঠছে প্রতারণার ছোট ছোট ফাঁদ। কসবার গৃহবধূ যে ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিলেন নিজের অজান্তেই। যেমন দিয়েছিলেন হুগলির বাসিন্দা বেসরকারি সংস্থার কর্মী। যেমন দিচ্ছেন এবং প্রতারিত হচ্ছেন আর আরও কত মানুষ! কারও ফাঁড়া কাটছে ৫০০ টাকার উপর দিয়ে। কারও যাচ্ছে ১৫ হাজার।

দৈনন্দিন জীবনের পদে পদে সাইবার প্রতারণার জাল বিছিয়ে রেখেছে দুষ্কৃতীরা। মানবসভ্যতার যাপন আধুনিক হয়েছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ হয়েছে আধুনিকতর। বিশেষজ্ঞেরা তাই বার বার বলছেন, প্রতি পদে সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। কলকাতা পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের প্রাক্তন ডিজি কল্যাণ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মানুষের বিশ্বাসের চূড়ান্ত সুযোগ নিচ্ছে সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা। কিউআর কোডে কী লেখা আছে, আমরা তো তা বুঝতে পারছি না! যখনই আমরা কিউআর কোড ব্যবহার করি, সরল বিশ্বাসে করি। অচেনা কারও দেওয়া কিউআর কোড তাই ঝট করে স্ক্যান না করাই ভাল। এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া খুব দরকার।’’ অচেনা কেউ ফোনে ভুল করে টাকা পাঠিয়ে ফেললে কী করণীয়? কল্যাণের পরামর্শ, ‘‘নিশ্চয়ই টাকা ফেরত দেবেন। ভুল তো হতেই পারে। কিন্তু থানায় দেখা করুন। যিনি টাকা পাঠিয়েছেন, তাঁকেও থানায় ডাকুন। নগদে তাঁকে টাকা ফেরত দিন। অনলাইনে নয়।’’

কসবার ঘটনাটি প্রসঙ্গেও সাবধান করেছেন কল্যাণ। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী সংস্থাগুলিই ক্রেতাদের তথ্য বিক্রি করে দেয়। নির্দিষ্ট এলাকার ছোটবড় ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে তথ্য কিনে সেই অনুযায়ী পসরা সাজান। ওই মহিলার কাছে যিনি এসেছিলেন, তিনি আদৌ ডেলিভারি বয় নন। সংস্থার কর্মীও নন। কিন্তু মহিলার অর্ডার সংক্রান্ত তথ্য তিনি পেয়ে গিয়েছেন অনায়াসে। তাই অচেনা লোকের দেওয়া কিউআর কোড কখনও স্ক্যান করবেন না। কাউকে করতেও দেবেন না।’’

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের হাতে হাতে এখন স্মার্ট ফোন। তাই নিজেকেও ‘স্মার্ট’ করে তোলার সময় এসে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সেই ‘স্মার্টনেস’-এর চাবিকাঠি হল সজাগ-সতর্ক-সাবধানি মন। নিজের কষ্টার্জিত অর্থকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করতে করতেই চিনে নিতে হবে ফাঁদ। নইলে জীবনে ঝঞ্ঝাট অবশ্যম্ভাবী। (চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyber fraud Cyber Crime Cyber Criminal Digital Frauds Digital crime Digital Arrest awareness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy