টলিউড থেকে রাজনীতি। রং ছুঁয়ে গেল সবাইকে। বাঁ দিক থেকে প্রিয়ঙ্কা সরকার, দিলীপ ঘোষ ও দিতিপ্রিয়া রায়।
করোনা-আতঙ্কের প্রভাব বেশ ভাল মতোই পড়েছিল দেশের রং-বাজারে। এ রাজ্যেও রং কেনাবেচায় ভাটা চলছিল। রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী, সকলেই রঙের উৎসবে জমায়েত এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যেই দেশ জুড়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩ ছুঁয়েছে। ফলে মনে করা হচ্ছিল, এ সবের প্রভাব এ রাজ্যের দোল উৎসবে ভালই পড়বে।
কিন্তু, দোলের দিন সকাল থেকেই দেখা গেল অন্য চিত্র। রাজনীতিবিদ থেকে সেলিব্রিটি, নেতা থেকে অভিনেতা, নায়ক থেকে গায়ক— সকলেই রং মাখলেন, মাখালেন। তবে, আতঙ্কে চিনা রং-কে দূরে সরিয়ে আবিরেই মেতে উঠলেন সকলে রঙের উৎসবে। শাসক থেকে বিরোধী প্রত্যেক দলেরই নেতানেত্রীকে সোমবার দেখা গিয়েছে রং খেলতে। এমনিতেই রঙের উৎসবের মাধ্যমে চিরকালই রাজনীতিবিদরা তাঁদের জনসংযোগের কাজটা করেন। রাজনৈতিক বিশেষ়জ্ঞরা বলছেন, সামনেই পুরভোট। ফলে, করোনা-আতঙ্ককে দূরে সরানো ছাড়া তেমন কোনও রাস্তাও ছিল না রাজনীতিবিদদের কাছে।
আরও পড়ুন: ৬০০ কোটির ঘুষ! ইয়েস ব্যাঙ্ক দুর্নীতিকাণ্ডে রাণা কপূরের স্ত্রী-কন্যার নামও জুড়ল সিবিআই
যেমন সোমবার সকাল থেকেই রঙে জমজমাট দক্ষিণ কলকাতার জনক রোড। সেখানকার দলীয় কার্যালয়ের সামনে প্রতি বছরের মতো এ বারও হাজির তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। শোভনের অনুগামীরা যখন বলছেন, ‘‘দাদা দোল খেলতে ভালবাসে’’, তখন তাঁর ছেলে সায়নদেব বলছেন, ‘‘ভালবাসে শুধু নয়, বাবার কাছে দোল আসলে একটা প্যাশন।’’
রঙয়ে মাতলেন টলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
রাজ্যের দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু যেমন লেকটাউনে তাঁর ক্লাবে দোলের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়েছিলেন। দুধ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি মুহূর্তের মধ্যেই একেবারে রঙিন। আবিরে-আবিরে সুজিত ভরিয়ে দিচ্ছিলেন সকলকে। সঙ্গে জোরকদমে গান-বাজনা। সেখানেও গলা মেলান রঙিন সুজিত। করোনা-আতঙ্কের আবহে রং খেলতে ভয় করছে না? হাসি মুখে সুজিতের জবাব, ‘‘সতর্কতা, সচেতনতা থাকুক। রঙের উৎসব থেকে আসলে সম্প্রীতির বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করতে চাই।’’
দলীয় সতীর্থদের মতো রং না খেললেও, এ দিন সকালে নিজের এলাকায় প্রভাতফেরি করেন মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। করোনা-আতঙ্ককে পরোয়া না করেই তাঁকে দেখা গেল বড়সড় জমায়েতে। রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ঘোষকেও আবির মেখে শামিল হতে দেখা যায় দোলের উৎসবে। মন্ত্রী তথা মেয়র ফিরহাদ হাকিমও এ দিন রঙের উৎসবে মাতেন।
রং খেললেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
একই রকম ভাবে রঙের উৎসবে শামিল হয়েছিলেন শাসকদলের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র তথা প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র। দিনভর বেলঘরিয়া এলাকায় কাটানোর ফাঁকে বললেন, ‘‘আমি দোল খেলিনি। কিন্তু দোল যাঁরা খেলেছেন তাঁদের সঙ্গে শামিল হয়েছি।” করোনা-আতঙ্কের মধ্যে রং? মদনের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, ‘‘বিশ্বভারতীতে বসন্তোৎসব বন্ধ করে পাড়ায় পাড়ায় এই রঙের উৎসবকে বন্ধ করা যাবে না।”
এ দিন রঙের উৎসবে মেতেছিলেন তৃণমূল নেত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘রং আমি প্রতি বছরই খেলি। তবে, এ বছর একটু অন্য রকম লাগছে। কারণ পূর্ব বেহালার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডটাও দেখছি। ওয়ার্ডের সকলে এসেছিলেন রং নিয়ে।’’
শুধু শাসক দলের নেতানেত্রী নন, বিরোধী শিবিরও তত ক্ষণে মেতে উঠেছে রং খেলতে। প্রধানমন্ত্রী রঙের উৎসবে জমায়েত এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এ রাজ্যের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ কিন্তু এ দিন রং মেখেছেন। অনেকেই তাঁকে রং মাখিয়েছেন। দিলীপ যে রং খেলবেন, তা আগেই জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মোদীজির মতো অত বড় মাপের নেতা নন বলে তাঁকে ঘিরে অত ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
উৎসবে মাতলেন বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ এবং সায়ন্তন বসু।
প্রতি বারের মতো তিনি এ বারও রং খেলেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছেন। একই রকম ভাবে রং খেলতে দেখা গিয়েছে রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্ত বসুকেও। হাতে পিচকারি নিয়ে, পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে রং খেলায় তিনি মেতে রইলেন দিনভর।
তবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন বিজেপি নেতা সব্যসাচী দত্ত। তিনি দোল খেলেননি এমন উদাহরণ বড় একটা পাওয়া যায় না। সেই সব্যসাচী কিন্তু এ বার রং হোক বা দোলের জমায়েত— সব কিছু থেকে দূরে! তাঁর অনুগামীদের বক্তব্য, ‘‘মোদীজি দোলের জমায়েত থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। সেটাই মেনে চলছেন দাদা।”
নিজের বাড়িতে রং খেলায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীকেও।
খেলব হোলি রং দেব না? বাঁ দিক থেকে শ্রীলেখা মিত্র ও ঋতাভরী চক্রবর্তী।
রাজনীতিকদের মতোই রঙে ভাসল গোটা টলিপাড়া। বড়, ছোট— বিভিন্ন মাপের অভিনেতা-অভিনেত্রীকে এ দিন দেখা গেল জমিয়ে দোল খেলতে। ব্যক্তিগত কারণে দেব, অঙ্কুশ, পায়েল সরকারের মতো কয়েকজন এ বার দোল না খেললেও মিমি, অনির্বাণ, শ্রাবন্তী হোক বা টেলি অভিনেত্রী রুপান্বিতা দাস সকলেই দিনভর মজে রইলেন নিজেদের রঙিন করে তুলতে।
মেদিনীপুরের বাড়িতে গিয়ে নিজের মতো করে রং খেলেছেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘বাড়ির লোকজনের সঙ্গে নিজের মতো করে দোল খেলছি। একটা ছবির চিত্রনাট্যও পড়লাম। ভালই কাটছে।’’ রঙের উৎসবে মেতে ওঠা প্রিয়ঙ্কা সরকার বললেন, ‘‘বাঘাযতীন তরুণ সঙ্ঘে সকালবেলা প্রভাতফেরিতে অংশ নিয়েছিলাম। তার পর ছেলে সহজকে নিয়ে রং খেলেছি। সন্ধ্যাবেলা দোলের অনুষ্ঠান রয়েছে।’’
তবে এই রঙের উৎসবেও বেশ কয়েক জন রাজনীতিক রংহীন থেকেছেন। যেমন রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। অন্যান্য বছর দোলের দিন তাঁকে দেখা যায় শামিল হতে। কিন্তু রবিবার রাতেই সুব্রতর এক ঘনিষ্ঠ অনুগামী বলেন, ‘‘দাদা এবার দোল খেলবেন না। আমাদেরও খেলতে না বলেছেন খেলতে। চার দিকে সবই তো চিনের জিনিস।” এই কারণে না হলেও, রং-জমায়েত সব থেকেই নিজেকে দূরে রেখেছেন রাজ্যের নারী সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা। তিনি বলেন, ‘‘আমি অন্য বছরও দোলের জমায়েতে খূব একটা থাকি না। অনেকেই নিজের নিজের কেন্দ্রে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এই দিনে। আমার দিনে কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়ার নেই। সন্ধ্যায় কয়েকটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা।”
রাজনীতিকদের মতো সেলেবদেরও অনেকে রঙের উৎসবে যোগ দেননি। তবে দেব-পায়েল-অঙ্কুশরা করোনা-আতঙ্কে দোল খেলেননি তেমনটা নয়। অভিনেতা-সাংসদ দেব কয়েক দিন আগেই শুটিং করতে গিয়ে পায়ে চোট পয়েছেন। এ বার রং খেলতে পারলেন না বলে মনও খারাপ। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘আমার পায়ে ব্যথা। তাই রং খেলতে পারছি না। যাঁরা খেলছেন, তাঁদের অনেক শুভেচ্ছা।’’ এ বার চুটিয়ে রং খেলবেন ভেবেছিলেন পায়েলও।
কিন্তু, দু’দিন আগে তাঁর হাত পুড়ে গিয়েছে। এক রাশ মন খারাপ নিয়ে তিনি বললেন, ‘‘ভেবেছিলাম রং খেলব। বাবা-মাকেও ডেকে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু দু’দিন আগে হাত গরম কফি পড়ে পুড়ে গিয়েছে। করোনার আতঙ্কে নয়, হাতে ইনফেকশনের ভয়েই এ বার আর খেলিনি।’’ অঙ্কুশও ভেবেছিলেন রং খেলবেন। তা হলে খেললেন না কেন? করোনা-আতঙ্ক? অঙ্কুশ বলছেন, ‘‘আরে না না, সবে দার্জিলিং থেকে শুটিং করে ফিরেছি। প্রস্তুতি নেওয়ারই তো সময় পেলাম না।’’ অপরাজিতা আঢ্যও রংহীন হয়েই থাকলেন। তবে করোনার ভয়ে নয়। তাঁর কথায়, ‘‘যে হিংসা-বিদ্বেষ চারদিকে, যে ভাবে রক্তাক্ত হচ্ছে চার পাশ, তার মধ্যে আনন্দ করতে মন চাইছে না।”
দোল উৎসবে মেতেছেন গায়ক নচিকেতাও। দোলের আগের দিন বিকেলে বেলগাছিয়ার মিল্ক কলোনি থেকে পাইকপাড়া— তিন-চার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে রং-গান-নাচের সঙ্গে তিনি পরিক্রমা করেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর প্রচুর গুণগ্রাহী। করোনা-আবহে এমন পরিক্রমার পরিকল্পনা? নচিকেতা বলেন, ‘‘আগুনপাখি কবেই বা কিসে ভয় পেয়েছে! উৎসব তো চির কাল মানুষকে মানুষের কাছে এনেছে। তাই পথে আবির নিয়ে নেমেছি।’’
আরও পড়ুন: করোনা-আতঙ্কে রঙের উৎসব ফ্যাকাসে, আবিরেই মেতে রইল কলকাতা
দিনের শেষে দেখা গেল, রাজনীতিবিদ বা সেলিব্রিটিদের দোলচিত্র অন্যান্য বারের চেয়ে কোনও অংশেই ফিকে নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy