Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

আবহে বদল, সঙ্গে হওয়া না-হওয়ার সংশয়ও

চলতি হাওয়ায় শেক্সপিয়রকে ঈষৎ বদলে বলা যেতে পারে, টু বি অর নট টু বি দ্যাট ওয়াজ দ্য কোয়েশ্চেন। সত্যিই, ২০১৮-র পাকে পাকে জড়িয়ে ‘হবে কি হবে না’-র বিবিধ দোলাচলতা।

বুদ্ধবাবুকে দেখতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশে বুদ্ধ-পত্নী মীরা। ফাইল চিত্র

বুদ্ধবাবুকে দেখতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশে বুদ্ধ-পত্নী মীরা। ফাইল চিত্র

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৭
Share: Save:

বদল। ছোট্ট এই শব্দটিকে ২০১৮-র ‘কি-ওয়ার্ড’ বললে বোধহয় খুব ভুল হবে না। বদলানোর ভাবনায় মশগুল বাঙালির বছরটা এ বার ‘বদল’ ভাবতে ভাবতেই পার হয়ে গেল!

চলতি হাওয়ায় শেক্সপিয়রকে ঈষৎ বদলে বলা যেতে পারে, টু বি অর নট টু বি দ্যাট ওয়াজ দ্য কোয়েশ্চেন। সত্যিই, ২০১৮-র পাকে পাকে জড়িয়ে ‘হবে কি হবে না’-র বিবিধ দোলাচলতা। বছরভর আমরা খুঁজেছি সেই সব প্রশ্নের উত্তর, যা বাঙালির ভাগ্যাকাশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে রোদে অথবা মেঘে! হয়তো বা গোটা দেশের চেহারাও। বছর শেষেও সব সংশয়ের জট খোলেনি। খোলার কথাও নয়। বরং বেশ কিছু এখনও রীতিমতো ধূসর। সৌজন্য রাজনীতি।

মোক্ষম চর্চায় অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালি এই বছর বোঝার চেষ্টা করেছে, জাতীয় রাজনীতিতে আগামী দিনে এই বঙ্গনেত্রীর অবস্থান কী হতে পারে? টু বি অর নট টু বি? লাল কেল্লা কত দূর? তিনি কি আদৌ পারবেন? এমনতর ভাবনা সারা বছর বাঙালিকে তর্কে, প্রশ্নে, দাবিতে এবং দাবি খণ্ডনে মুখর রেখেছে। যার সঠিক উত্তর ২০১৯ জানে। কিন্তু আপাতত দেওয়ালের লেখায়, বক্তৃতার মঞ্চে, আশার স্বপ্নে ‘শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ জাতীয় আহ্বানে বঙ্গ-শ্লাঘার ছোঁয়াটুকুই বা মন্দ কী!

পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী-পরিসরে বদলের একটা ঢেউ অবশ্য ধাক্কা দিয়েছে কয়েক বছর আগেই। পাশাপাশি প্রতিবেশী বাঙালি-রাজ্য ত্রিপুরায় এ বার বদলের ঢেউয়ে সুনামি! পশ্চিমবঙ্গে এখন যারা প্রধান বিরোধী দল, দীর্ঘদিনের বামশাসিত ত্রিপুরায় তারাই শাসকের গদিতে বসেছে। তবে এই রাজ্যে তাদের রথের পথ কতটা মসৃণ, সেই সংশয় পুরোপুরি জারি রেখেই বছর ফুরোল।

লোকসভা নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এটা ছিল রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের বছর। গণতন্ত্রের ‘রণাঙ্গনে’ প্রাণহানি, রক্তক্ষয়, আতঙ্কের বাতাবরণ ইত্যাদি এখন জলভাত! এই একটা জায়গায় বাঙালি সম্ভবত বড়ই বদল-বিমুখ! ভোট শেষ পর্যন্ত হতে পারবে কি না, সেই অনিশ্চয়তা এ বার মনোনয়নের সময় থেকেই যে পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা-ও নজিরবিহীন। সামনে আরও বড় নির্বাচন। সেখানেও কি গণতন্ত্র এমনই রক্তাক্ত হবে? ২০১৮ সে আশঙ্কা জিইয়ে রাখল।

বদলে গেলেন কলকাতার মেয়র। শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ছেড়ে দেওয়া চেয়ারে ফিরহাদ হাকিম। সেই বদলের জন্য আবার বদলাতে হল আইন। ব্যক্তি শোভনের কার্যকলাপ নিয়ে উচিত-অনুচিতের বিশ্লেষণ অনেক হয়েছে, হবেও। কিন্তু ‘প্রিয়’ নারীর জন্য পদ, ক্ষমতা, মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান সব ‘হেলায় তুচ্ছ’ করার যে দৃষ্টান্ত রাজনীতিক শোভন গড়লেন, এক অর্থে তা-ও তো বদলেরই মুখচ্ছবি। এটা নিঃসন্দেহে বছরের বিস্ময় বলে গণ্য হতে পারে!

প্রতিস্থাপনের জন্য কলকাতা মেডিক্যালে নিয়ে আসা হয়েছে হৃৎপিণ্ড। ফাইল চিত্র

অসমের নাগরিক পঞ্জি আবার বাংলাভাষীদের জন্য বছরের আতঙ্ক। কার্যত অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে থাকা কয়েক লক্ষ বঙ্গভাষীর দিন কি বদলাবে? বংশ পরম্পরায় অসমে বসবাসকারী বঙ্গভাষীদের নিয়ে বঙ্গবাসীদের এই উদ্বেগ বর্ষশেষেও কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল। ২০১৮-র এটি এক কলঙ্কিত অধ্যায়। এখনও জানা গেল না, অসমের নাগরিক পঞ্জি থেকে তাঁদের নাম শেষ পর্যন্ত কেটে দেওয়া হবে কি না। নাম বাদ গেলে ভারতের মাটিতে কী হবে তাঁদের পরিচয়? টু বি অর নট টু বি....?

কিছু বদল আঁধারে আলোর রেখা দেখায়। মন ভাল করে দেয়। আমরাও পারি, ভেবে আশা জাগে। মৃতের অঙ্গদান তারই একটি। মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে দেহের ক্রিয়াশীল অঙ্গগুলি অন্য গ্রহীতার শরীরে সংস্থাপন করার গুরুত্ব মহান। কিন্তু এ নিয়ে সংস্কার, মানসিক বাধা, অজানা ভয় এবং অবৈজ্ঞানিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা অনেকের মধ্যে কাজ করে। ২০১৮ সেখানেই এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এই বছর রাজ্যে অঙ্গদানের সদিচ্ছা নজরকাড়া। বঙ্গ-মানসিকতার এই বদলকে কুর্নিশ করা কর্তব্য।

বিজ্ঞান-চর্চাতেও বাঙালির এটা গর্বের বছর। বিজ্ঞান-সাধনায় দেশের সেরা পুরস্কার শান্তিস্বরূপ ভাটনগর প্রাপকের তালিকায় এ বার পাঁচ জন বঙ্গসন্তান— রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বাধীনকুমার মণ্ডল, পার্থসারথি চক্রবর্তী, অদিতি সেন ও অম্বরীশ ঘোষ।

হাইড্রোজেনকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প শক্তি তৈরির দিশা দেখিয়েছেন রাহুল। স্বাধীনের গবেষণা কার্বন ডাই অক্সাইডকে ব্যবহার করে মিথানলের মতো জ্বালানি তৈরি। তাঁরা দুজনেই কল্যাণীর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্টিফিক এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর শিক্ষক। ইলাহাবাদের হরিশ্চন্দ্র রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অদিতি নেট মাধ্যমে নিরাপদ পথের সন্ধানে পদার্থবিদ্যার ব্যবহার নিয়ে কাজ করেছেন। ক্যানসার মোকাবিলায় ন্যানো সায়েন্সকে কাজে লাগানোর বিষয়ে গবেষণা করে স্বীকৃতি পেয়েছেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের অম্বরীশ। পার্থসারথির গবেষণার বিষয় পরিবেশ ও অর্থনীতিতে সামুদ্রিক বিভিন্ন ধাতুর প্রভাব।

উল্লেখ করতে হয় অভিরূপ ঘোষের নামও। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সংক্রান্ত নোবেলজয়ী গবেষণার সঙ্গে তরুণ এই বাঙালি বিজ্ঞানী জড়িত।

খেলার মাঠে বাঙালিকে এ বার সব চেয়ে বেশি গর্বিত করেছেন স্বপ্না বর্মণ। অগস্টে ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত এশিয়ান গেমসে প্রথম ভারতীয় অ্যাথলিট হিসাবে হেপ্টাথেলনে সোনা এনেছেন তিনি। আঘাত কাটিয়ে উঠে দীপা কর্মকার আবার সোনা জিতলেন তুরস্কে জিমন্যাস্টিক্স বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। আর কমনওয়েলথ গেমসে টেবিল টেনিসে দলগত বিভাগে সোনা জিতে নজির গড়েছেন মৌমা দাস ও সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়।

সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যান্য ধারায় কিন্তু এ বারেও খুব বেশি বলার নেই। নতুন মুখের উদ্ভাস তো নেই-ই। শুধু ‘নগরকীর্তন’ ছবিতে তরুণ অভিনেতা ঋদ্ধি সেনের জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার উল্লেখ করা যেতে পারে।

সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে বাঙালির হারানোর পাল্লা বরং এ বছর তুলনায় ভারী। বছরের গোড়ায় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরীর প্রয়াণ দিয়ে শুরু। বছরের মাঝামাঝি সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর জীবনাবসান। একেবারে শেষ পর্বে বড়দিনের আলো ম্লান করে পরপর দু’দিনে প্রয়াত হলেন সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এবং কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বছর ফুরনোর ঠিক আগে চিরবিদায় নিলেন পরিচালক মৃণাল সেন। পরিণত বয়সে মৃত্যু দুঃখের হলেও আকস্মিকতার ধাক্কা হয়তো কিছু কম। কিন্তু যাঁরা চলে গেলেন, নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা প্রত্যেকে ইতিহাস তৈরি করেছেন। ওঁরা সকলেই ছিলেন বাঙালির ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। এই সব মৃত্যু-আঘাত তাই বড় বেশি প্রাণে লাগে।

প্রবীণ বামপন্থী এবং লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুও চলতি বছরের আর এক উল্লেখযোগ্য অবসান। বছরশেষে প্রয়াত হলেন সিপিএম নেতা নিরুপম সেন— মমতার সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় যিনি ছিলেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী।

ঘটনাচক্রে এই বছরেই একাধিক বার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাড়ি গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গে সৌজন্যের সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। তাঁর সাত বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে এ বারই প্রথম মমতার এমন পদক্ষেপ। এ-ও কি কোনও বদলের লক্ষণ? বিষয়টি নজর এড়ায় না।

আসলে ‘বদল’ মানেই তো এক ধরনের চলমানতা। মন বদল, ঘর বদল, দল বদল, সরকার বদল যা-ই হোক, প্রকৃতপক্ষে সবই স্থিতাবস্থা থেকে অন্যতর অবস্থানে চলে যাওয়া। পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই চলা এগিয়ে দিতে পারে, পিছনেও টানতে পারে। তবু বদলের ‘শপথ’ নেওয়া অনেক সময় জরুরি হয়। কারণ তাতে নতুনে পৌঁছনোর একটি চ্যালেঞ্জ থাকে।

২০১৮-র ক্যালেন্ডার বদলানোর দিনে কী ভাবছে বাঙালি? চ্যালেঞ্জ নেবে? ২০১৯-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নটি অর্থবহ। স্বাগত নতুন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE