ছুটির সঙ্গে তাঁরা কোনও রফা করবেন না বলে জানিয়ে দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের বড় অংশ।
সোমবার কলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ডাকা সভায় প্রবীণ আইনজীবীদের কয়েক জন হোলির দিনের ছুটির বদলে আগামী ১৮ এপ্রিল, শনিবার ছুটির দিনে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। গোপন ব্যালটে মতামত দেওয়ার পক্ষেও সওয়াল করেন প্রবীণ আইনজীবীদের কেউ কেউ। কিন্তু ধ্বনি ভোটে সেই সব প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এ বার প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরকে তাদের এ দিনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবে হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন।
গত শুক্রবার, হোলির দিন রাজ্য সরকারের ছুটি ছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিন কলকাতা হাইকোর্টে ছুটি ঘোষণা করার জন্য প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেয় বার অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু সেই প্রস্তাব খারিজ করে প্রধান বিচারপতি বার অ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়ে দেন, বছরে ২১০ দিন কলকাতা হাইকোর্ট খেলা রাখতেই হবে। তাই তিনি হোলির দিনে ছুটির প্রস্তাব খারিজ করে দিচ্ছেন। প্রধান বিচারপতি বার অ্যাসেসিয়েশনকে জানিয়ে দেন, অন্য একটি ছুটির দিন কাজ করে পুষিয়ে দিলে তিনি শুক্রবারের ছুটি মঞ্জুর করতে পারেন। কিন্তু বার অ্যাসোসিয়েশন সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ফলে হোলির দিন বিচারপতিরা হাজির থাকলেও শতকরা ৮৫ ভাগ আইনজীবীই কাজে যোগ না দেওয়ায় কলকাতা হাইকোর্ট কার্যত অচল ছিল। এই ঘটনায় আইনজীবীদের দায়িত্ববোধ নিয়েই প্রশ্ন তোলেন প্রধান বিচারপতি। সে সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল। তিনি প্রধান বিচারপতির এই বার্তা বার অ্যাসোসিয়েশনের কাছে পৌঁছে দেন। তার ভিত্তিতেই এ দিন জরুরি সভা তলব করে বার অ্যাসোসিয়েশন।
অ্যাসোসিয়েশন সূত্রের খবর, আইনজীবীদের একটা অংশ প্রধান বিচারপতির প্রস্তাব মেনে হোলির ছুটির বদলে অন্য একটি ছুটির দিনে কাজ করার পক্ষে সওয়াল করে আসছিলেন গত কয়েক দিন ধরেই। তাঁদের আশা ছিল, পেশাগত ভাবমূর্তির দিকে লক্ষ্য রেখে অধিকাংশ আইনজীবীই সেই প্রস্তাব মেনে নেবেন। কিন্তু তা হয়নি। অধিকাংশ আইনজীবীই ছুটির সঙ্গে আপস করতে না চাওয়ায় এ বার আর হাইকোর্টে নিয়ম মেনে ২১০ দিন কাজ হবে না। কারণ ইতিমধ্যেই হোলির দিনের একটি কর্মদিবস নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
বার অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠকে এ দিন কী হয়েছে? সূত্রের খবর, এই বৈঠকে প্রবীণ আইনজীবী শেখর বসু প্রস্তাব দেন, হোলির বদলে ১৮ এপ্রিল (যেটি শনিবার হওয়ায় ছুটির দিন) কাজ করা যায় কি না, সংগঠনের সদস্যেরা তা ভেবে দেখুন। অন্য এক প্রবীণ আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাব ছিল, প্রয়োজনে সদস্যেরা তাঁদের মতামত গোপন ব্যালটে জানাতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ আইনজীবীই তাঁদের সংগঠনের সম্পাদক রানা মুখোপাধ্যায়কে জানিয়ে দেন, প্রধান বিচারপতির অনুরোধ তাঁরা মানতে নারাজ। সভা শেষের আগেই সম্পাদক জানান, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যে অন্য কোনও ছুটির দিনে কাজ করতে চাইছেন না, তা সংগঠনের তরফে প্রধান বিচারপতিকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
সূত্রের খবর, অধিকাংশ আইনজীবীই জানান, এই সভার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। হোলির দিন আইনজীবীদের অনুপস্থিতির কারণে বিচারপতিরা যদি কোনও মামলার একতরফা নিষ্পত্তি করেন বা মামলা খারিজ করেন, সে ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। হোলির ছুটির বদলে অন্য কোনও দিন কাজ হবে কি না, সেই ব্যাপারে আলোচনার জন্য এ দিন বৈঠক ডাকা হয়নি। তাই ওই বিষয়ে কোনও আলোচনা হবে না।
এ দিনের সিদ্ধান্তে আইনজীবীদের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেল বলে মন্তব্য করে কলকাতা হাইকোর্টের এক প্রবীণ আইনজীবীর প্রশ্ন, “এ বার যদি আইনজীবী ছাড়াই কেবল মাত্র নথির ভিত্তিতে কোনও মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য প্রধান বিচারপতি নির্দেশ জারি করেন, তা হলে আইনজীবীরা কী করবেন, ভেবেছেন কি?” ওই আইনজীবী বলেন, কোনও মামলায় বিচারপ্রার্থী কিংবা অভিযুক্ত যেমন আইনজীবী ছাড়াই আদালতে সওয়াল করতে পারেন, তেমনই অনেক ক্ষেত্রেই কেবল মাত্র নথি দেখে মামলার নিষ্পত্তি করা যায়। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে শুধু নয়, এ দেশের সুপ্রিম কোর্ট এমনকী কলকাতা হাইকোর্টেও কেবল নথি দেখেই মামলার নিষ্পত্তি করার নজির রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বলেন, “বিচার পাওয়াটা বিচারপ্রার্থীর অধিকার। সেই অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা সংবিধান কাউকেই দেয়নি। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের উচিত ছিল, শুক্রবারই বিচারপতিদের কেবল মাত্র নথি দেখে মামলার নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেওয়া। তা হলে জল এত দূর গড়াত না।” শ্রীরামপুর আদালতে এক বিচারকের এজলাস ৫০ দিন ধরে বন্ধ রেখে আইনজীবীরা আন্দোলন করলেও হাইকোর্ট কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। আলিপুর আদালতে এক শ্রেণির আইনজীবী বিচারককে হুমকি দেওয়ার পরেও হাইকোর্ট নীরব থেকেছে। সুপ্রিম কোর্টের ওই আইনজীবীর মন্তব্য, “ওই সব ক্ষেত্রেও কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নথির ভিত্তিতে মামলার নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতো।” যদিও আইনজীবীদের একাংশের দাবি, দু’পক্ষের বক্তব্য না শুনে কেবল মাত্র নথির ভিত্তিতে রায় দেওয়াটা অগণতান্ত্রিক। এতে অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী দু’পক্ষেরই অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। কারণ নথি ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রেই দু’পক্ষের সওয়াল-জবাব রায়দানের ক্ষেত্রে বিচারপতিকে সাহায্য করে।
এ দিন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীদের বড় অংশই ছুটির সঙ্গে রফা করতে না চাওয়ায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “যাঁরা ছুটির সঙ্গে আপস করলেন, তাঁরা জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিলেন।” বম্বে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “বিষয়টি মূল্যবোধের। হাইকোর্টের কর্মপঞ্জী তৈরি হয়ে গেলে তার নড়চড় করা মুশকিল। এতে বিচারপ্রার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”
আইনজীবীরা কি তা হলে তাঁদের অবস্থানে অনড় থাকবেন?
আইনজীবী সপ্তাংশু বসু বলেন, ‘‘বিচারপতিদের সঙ্গে আইনজীবীদের সংঘাত নেই। কিন্তু প্রধান বিচারপতিকেও আশ্বাস দিতে হবে, বার অ্যাসোসিয়েশনের অভাব-অভিযোগ শুনে সমস্যার সমাধান করা হবে। কোনও বিষয় একতরফা হয় না।’’
প্রবীণ আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ এ দিন বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি চাইছেন, তাঁর অনুরোধ মানতে বাধ্য হোন আইনজীবীরা। তিনি আইনজীবীদের কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর অধীনে হাইকোর্টে যে সব বিচারপতি রয়েছেন, তাঁদের সকলের কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর ব্যবস্থা করছেন না। হোলির দিন প্রধান বিচারপতি-সহ বেশ কয়েক জন বিচারপতি হাজির ছিলেন। কিন্তু সব বিচারপতি তো হাজির ছিলেন না। এমনকী এ দিনও একাধিক বিচারপতি কাজে যোগ দেননি।’’
এই পরিস্থিতি কত দিন চলবে?
হাইকোর্ট সূত্রের খবর, কয়েক জন প্রবীণ বিচারপতি চাইছেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আইনজীবীদের সবক’টি সংগঠনের প্রতিনিধিদের বৈঠকে বসিয়ে সমস্যা মেটাতে। সেখানে আইনজীবীদের সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আলোচনা হোক। আবার, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো কী ভাবে হাইকোর্ট কমপক্ষে ২১০ দিন খুলে রাখা যায়, কাজের সময় কী ভাবে আরও বাড়ানো যায়, সেই বিষয়েও ওই বৈঠকে আলোকপাত করুন আইনজীবীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy