প্রায় দশ বছর ধরে নিঃশব্দে সদস্য সংগ্রহ করে ‘নারায়ণী সেনা’ নামে মস্ত একটি বাহিনী গড়ে ফেলেছে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন (জিসিপিএ)। এ বার সেই দলে নাম লেখাতে লাইন পড়ে গিয়েছে। কারণ, কোচবিহার জুড়ে চাউর হয়ে গিয়েছে, নারায়ণী সেনা এ বার ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নতুন রেজিমেন্ট হিসেবে যোগ দিতে চলেছে। এই প্রচারের পিছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা দার্জিলিং সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়ার একটি চিঠি। বিষয়টি জানার পরে নড়েচড়ে বসেছে রাজ্য প্রশাসন। তাদের আশঙ্কা, এই দাবিকে কেন্দ্র করে নতুন অশান্তির মেঘ ঘনাতে পারে অসম ও বাংলাদেশ সংলগ্ন এই জেলায়।
কী রয়েছে সেই চিঠিতে? নবান্নের খবর, চিঠিতে অহলুওয়ালিয়া কোচ-রাজবংশীদের জন্য একটি পৃথক সেনা রেজিমেন্ট তৈরির দাবি জানিয়েছেন। যার প্রস্তাবিত নামও বলা হয়েছে ‘নারায়ণী রেজিমেন্ট’। সেই সঙ্গে কোচবিহার রাজাদের যাবতীয় দেবোত্তর সম্পত্তি, মন্দিরগুলির পরিচালনভার সরকারের হাত থেকে নিয়ে কোচ রাজাদের বংশধরের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন বিজেপি সাংসদ। তাঁর যুক্তি, ১৯৪৯ সালের ২৮ অগস্ট ভারতে অন্তর্ভুক্তির সময় কোচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্রের সঙ্গে ভারতের গভর্নর জেনারেলের উপদেষ্টা ভি পি মেননের যে চুক্তি হয়েছিল, সেখানেই কোচ সেনাদের ভারতীয় বাহিনীতে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেই রেজিমেন্টের নামের সঙ্গে নারায়ণী শব্দটি যুক্ত থাকবে বলেও তখন বলা হয়েছিল। অহলুওয়ালিয়ার দাবি, কার্যক্ষেত্রে সেই চুক্তি মানা হয়নি। এই ঘটনাকে তিনি বিশ্বাসভঙ্গের সামিল বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
চার মাস আগের সেই চিঠির ভিত্তিতে রাজনাথ সিংহের মন্ত্রক এ বার ‘নারায়ণী সেনা’ গঠন নিয়ে রাজ্যের মতামত জানতে চেয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের আশঙ্কা, এ বার নতুন করে বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা শুরু হবে। যার ফলে ফের উত্তাল হতে পারে কোচবিহার জেলা।
তার একটা ইঙ্গিত মিলেছে নতুন করে নারায়ণী সেনায় নাম লেখানোর হিড়িকে। মাথা পিছু ২০০ টাকা লাগছে নাম লেখাতে। জিসিপিএ নেতৃত্ব আশা করছে, ২৮ অগস্টের মধ্যে ৫০-৬০ হাজার সদস্য হয়ে যাবে নারায়ণী সেনার। সে দিন এই সেনাবাহিনী ‘অনন্ত মহারাজ’কে গার্ড অব অনার দেবে বলেও জানা গিয়েছে। অনন্ত নিজেকে মহারাজ এবং গোসানিমারির রাজবংশের সন্তান বলে পরিচয় দেন। এই
অনন্ত রায়ের হাতেই এখন জিসিপিএ-র রাশ।
অহলুওয়ালিয়ার চিঠি, কেন্দ্রের খোঁজ-তদ্বির এবং তার ফলে নারায়ণী সেনায় নতুন জোয়ার যে নতুন সমস্যা তৈরি করতে পারে, সে খবর পৌঁছেছে নবান্নেও। শুনেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। রাজ্য স্বরাষ্ট্র কর্তাদের দাবি, ‘‘সামনে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন থাকলেও এর ফলে গত কয়েক বছরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া কেএলও ফের মাথাচাড়া দেবে।’’ এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, ‘‘নারায়ণী রেজিমেন্ট নিয়ে ইতিমধ্যেই কোচবিহারে আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতি চলছে বলে খবর। সম্প্রতি অসমের বড়ো-এলাকায় যে ভাবে উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিচ্ছে, তার ধাক্কা এই রাজ্যেও লাগতে পারে। কারণ, কেএলও ও বড়ো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলছে।’’
সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বিষয়টি নিয়ে বিশদে রিপোর্ট তলব করেছেন। শুধু তাই নয়, যে ভাবে ভারতে মিশে যাওয়া কোচবিহারের রাজ আমলের পতাকা, সেনাবাহিনীর পোশাক, লাঠি, তরোয়াল নিয়ে জিসিপিএ মহড়া দিচ্ছে, তা চুক্তি-বিরোধী বলেও মনে করছেন পুলিশ-প্রশাসনের অনেকেই। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানান, সেনা-পুলিশের নাম জড়িয়ে সংগঠনে লোকজনকে টানা দেশবিরোধী কাজ সেটা সকলকেই বুঝতে হবে।
সরকারি মহলে অনেকেই বলছেন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হলেও ‘সেনা’ বা ‘পুলিশ’ শব্দটি কোনও বেসরকারি সংগঠন ব্যবহার করতে পারে না। অতীতে পাহাড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ‘গোর্খাল্যান্ড পুলিশ’ (জিএলপি) নামে আসরে নামার পরেও রাজ্যের চাপে পড়ে তা ‘গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল’ নামে বদলে নিতে বাধ্য হয়। তা হলে দশ বছর ধরে কোচবিহারে ‘নারায়ণী সেনা’ আড়েবহরে বাড়ল কী করে, এই প্রশ্ন উঠেছে শাসক দলের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যেই। তাঁদের আরও প্রশ্ন, কেন সব কিছু জানার পরেও পুলিশ-প্রশাসন বা গোয়েন্দারা হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন এত দিন? ফি বছর ২৮ অগস্ট ‘চুক্তি দিবস’ পালনের অনুমতিই বা কী ভাবে পায় জিসিপিএ? জিসিপিএ-এর সাধারণ সম্পাদক নমিতা বর্মন অবশ্য আশাবাদী, এ বারেও তাঁরা অনুষ্ঠান করার অনুমতি পাবেন।
অনন্ত রায়ও মনে করেন না, তাঁরা কোনও দেশ বিরোধী কাজ করছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কোচবিহারের রাজার ভারত ভুক্তির সময়ে নারায়ণী সেনা ছিল। সেই নামে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়েছি। কোচবিহারের ভারত-ভুক্তির চুক্তি মেনে আগামী দিনে ভারত সরকারকে নারায়ণী সেনা তৈরি করতেই হবে।’’ তাঁর দাবি, ভারত সরকার তাঁদের সেই আশ্বাসও দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অহলুওয়ালিয়াও খোলাখুলি নারায়ণী সেনার দাবি মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘গত বিধানসভা ভোটের প্রচারের সময় প্রধানমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে এলে, তাঁর কাছেও দাবি তোলা হয়। দাবি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, এবং বিবেচনাও করা হচ্ছে।’’
রাজ্যের রাজনীতিকদের একাংশ অবশ্য বলছে, একাধিক কারণে গ্রেটার আন্দোলনকারীদের সমর্থন করেছে বিজেপি। প্রথমত, জিসিপিএ হল এনডিএ-র শরিক দল। বিজেপির ভোট প্রচারেও তারা অংশ নিয়েছে। অহলুওয়ালিয়াকে সংবর্ধনাও দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ বার বিধানসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি। তারা সেই ভিত মজবুত করতে মোর্চা, গ্রেটারের মতো সহযোগী দলগুলির দাবিদাওয়ার প্রতি মনোযোগ দেবে। সর্বোপরি, নীতিগত ভাবে বিজেপি ছোট রাজ্যের সমর্থক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy