Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
গান-স্যালুটে বিদায়

অশ্রুবৃষ্টিতে পঞ্চভূতে লীন সন্ন্যাসী

প্রয়াণের রাত জেগেছেন অনেক ভক্তই। সোমবার ভোরে ভাল করে আলো ফোটার আগে থেকেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে ভক্তের সারি। বেলুড় মঠের সংস্কৃতি ভবনের সামনে তাঁরা সমবেত হয়েছেন স্বামী আত্মস্থানন্দকে শ্রদ্ধা জানাতে।

শ্রদ্ধা: সেবাব্রতী সন্ন্যাসী স্বামী আত্মস্থানন্দকে সম্মান গান স্যালুটে। সোমবার বেলুড় মঠের গঙ্গাতীরে অন্তিম সংস্কারের আগে। ছবি: সুমন বল্লভ।

শ্রদ্ধা: সেবাব্রতী সন্ন্যাসী স্বামী আত্মস্থানন্দকে সম্মান গান স্যালুটে। সোমবার বেলুড় মঠের গঙ্গাতীরে অন্তিম সংস্কারের আগে। ছবি: সুমন বল্লভ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৭ ০৪:১১
Share: Save:

মুহুর্মুহু ‘হরি ওম রামকৃষ্ণ’ ধ্বনিতে মুখর বেলুড় মঠ প্রাঙ্গণ। যত না ধ্বনি-বন্দনা, তার থেকে কিছু কম নয় অশ্রুধারার নীরব নিবেদন। শুকনো নেই আকাশের চোখও।

সোমবার রাত পৌনে ১০টা। বেলুড় মঠে প্রেসিডেন্ট মহারাজের নতুন বাসভবনের সামনে শায়িত সন্ন্যাসীর মরদেহ। শূন্যে গুলি ছুড়ে গান-স্যালুট দিলেন হাওড়া সিটি পুলিশের জওয়ানেরা। আজীবন নিরলস সেবাকাজে নিবেদিতপ্রাণ সন্ন্যাসীকে রাষ্ট্রের অভিবাদন। মাদার টেরিজার পরে রাজ্যে এই প্রথম এ ভাবে রাষ্ট্রীয় অভিবাদন পেলেন কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান।

বেলুড় মঠের এই নতুন ভবন তৈরির পরে সেখানে মাত্র তিন মাস থাকতে পেরেছিলেন পঞ্চদশ প্রেসিডেন্ট স্বামী আত্মস্থানন্দ। তার পর থেকে তাঁর দীর্ঘ সময় কেটেছে সেবা প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের শয্যায়। জীবদ্দশায় আর ফেরা হয়নি ওই ভবনে। দেহাবসানের পরে অন্তিম সংস্কারের জন্য সেই ভবনের সামনেই এনে রাখা হয় প্রেসিডেন্ট মহারাজের পার্থিব শরীর। শেষ লগ্নে তাঁর মরদেহ ছুঁয়ে বসলেন সন্ন্যাসীরা, যাঁদের অনেকেই সন্ন্যাস ও ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা নিয়েছেন স্বামী আত্মস্থানন্দের কাছে। দক্ষিণেশ্বরের দিকে মাথা রেখে শায়িত সন্ন্যাসীকে ঘিরে আছেন মঠ ও মিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টরা।

রবিবার প্রয়াণের পরে সেই রাত থেকে সোমবার দিনভর সভাগৃহে শায়িত ছিল সন্ন্যাসীর নশ্বর দেহ। রাত থেকেই সমানে চলে ভক্তের স্রোত। সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামলেও অন্তিম সংস্কারের বিধিবদ্ধ আচার-অনুষ্ঠানে নড়চড় হয়নি। সুশৃঙ্খল ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে অন্তিম মুহূর্তের অপেক্ষায় থেকেছে ভক্ত-জনতা। সভাগৃহ থেকে মঠের মূল অফিস প্রাঙ্গণ, প্রথম মঠাধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব, মা সারদাদেবী, স্বামী বিবেকানন্দের মন্দির ছুঁয়ে প্রেসিডেন্ট মহারাজের পার্থিব শরীরকে গঙ্গাস্নান করানো হলো। পরানো হলো নববস্ত্র। দেওয়া হলো সন্ন্যাসীর দণ্ডী ও ঝোলা। তার পরেই গান-স্যালুট। বৃষ্টিস্নাত রাতেই জ্বলে উঠল চিতা। মুহুর্মুহু উঠল ‘জয় গুরু মহারাজ’ ধ্বনি। সন্ন্যাসীরা গেয়ে উঠলেন ‘ওই দেখা যায় আনন্দধাম’।

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নিয়ম অনুযায়ী গঙ্গার পূর্ব পাড়ে ঠিক যে-জায়গাটিতে পূর্বজ সন্ন্যাসীদের অন্তিম সংস্কার হয়েছে, স্বামী আত্মস্থানন্দের নশ্বর দেহ দাহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানেই। ভারে ভারে আনা হয়েছিল চন্দনকাঠ। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এই প্রথম রামকৃষ্ণ মিশনের কোনও অধ্যক্ষের অন্তিম সংস্কার হলো বলে মঠ সূত্রের খবর। সুবীরানন্দ মহারাজ বলেন, ‘‘এমন আগে হয়েছে বলে জানা নেই। রাজ্য সরকার প্রস্তাব দিয়েছিল, আমরা সম্মতি দিয়েছি।’’

প্রয়াণের রাত জেগেছেন অনেক ভক্তই। সোমবার ভোরে ভাল করে আলো ফোটার আগে থেকেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে ভক্তের সারি। বেলুড় মঠের সংস্কৃতি ভবনের সামনে তাঁরা সমবেত হয়েছেন স্বামী আত্মস্থানন্দকে শ্রদ্ধা জানাতে। সেই সারিতে কে নেই! সাধারণ মানুষ থেকে মন্ত্রী, বিদ্বজ্জন থেকে চিকিৎসক, বৃদ্ধ, তরুণ— সকলেই।

রবিবার রাত থেকে সোমবার পর্যন্ত দু’দফায় ফোন করে খোঁজ নেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিদেশ যাওয়ার আগে অন্তিম সংস্কারের ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে খোঁজখবর নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। মঠ ও মিশনের সাধারণ সম্পাদক সুবীরানন্দ মহারাজ বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বিমানবন্দর থেকে ফোন করে অন্তিম সংস্কারের প্রস্তুতির খোঁজ নেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এই মৃত্যুতে তিনি স্বজন হারানোর বেদনা পেয়েছেন।’’

পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও পুর-নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে অন্তিম সংস্কারের সমস্ত ব্যবস্থা খুঁটিয়ে দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক সময়ে পৌঁছে যান তাঁরা। সকাল থেকে মঠে থেকে অন্তিম সংস্কারের সমস্ত আয়োজনের তদারক করেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

রবিবার বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটে দেহাবসান হয় স্বামী আত্মস্থানন্দের। রাতেই অ্যাম্বুল্যান্সে তাঁর মৃতদেহ এনে রাখা হয় মঠের সংস্কৃতি ভবনের ভিতরে। রাত থেকেই চলে মন্ত্রোচ্চারণ, ভক্তদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। সকাল থেকে সময় যত গড়িয়েছে, ততই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন চত্বরে ভিড় বেড়েছে। ফুল-মালার পাহাড় জমেছে সংস্কৃতি ভবনে শায়িত স্বামী আত্মস্থানন্দের পায়ের কাছে।

মুষলধার ব়ৃষ্টিতেও টাল খায়নি ভক্ত-সমাবেশ। দু’ধারে সারি বেঁধে বসানো হয় তাঁদের। ঠাকুর ও স্বামীজির গানের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল ভজন। ভিজে চুপচুপে হয়ে অধ্যক্ষ আবাসের সামনে সপরিবার দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ভক্ত। জানালেন, ব্যক্তিজীবনে দুর্যোগের পরে মানসিক শক্তি পেয়েছিলেন ‘গুরু’র কাছেই। অন্য এক ভক্ত ভিজতে ভিজতে বললেন, ‘‘মহারাজ যাওয়ার পথে সকলকে শান্তিবারি দিয়ে গেলেন।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE