চৌর্যবৃত্তি চৌষট্টিকলার একটি। প্রতারণা সেই চুরিবিদ্যারই এক নাম। চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা ঠিকই। কিন্তু যদি না ধরা পড়ে, তবেই! আর যদি ধরা পড়ে?
ধরা পড়লে কী হয়, শ্রীঘরে বসে টের পাচ্ছেন নদিয়াবাসী সৌরভ মিত্র।
খোয়াব দেখতেন, পাঁচতারা হোটেলে কয়েক দিন কাটাবেন। সেই সাধ মিটেছে। টানা ন’দিন মধ্য কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে মটন বিরিয়ানি, চিকেন চাঁপ সেবন করেছেন আকণ্ঠ। সঙ্গে অনুপান ছিল মহার্ঘ বিদেশি সুরা। এবং অবশ্যই প্রতি রাতে নতুন, নতুনতর বান্ধবী।
এত সব বাসনা পূরণ হলেও প্রতারণা-প্রবৃত্তির শেষ রক্ষা হয়নি। পাঁচতারা হোটেলের বকেয়া প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা না-দেওয়ায় এখন জেলে লপসি খাচ্ছেন নদিয়ার তাহেরপুরের বাসিন্দা সৌরভ।
পুলিশি সূত্রের খবর, মালয়েশিয়া, ব্যাঙ্ককে শ্রমিক সরবারহ করে কয়েক বছরে আচমকা রমরমা বেড়ে গিয়েছিল সৌরভের। বাড়িতে স্ত্রী আছেন, সন্তানও। অথচ সৌরভের মা লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। বাবা গ্রামেরই এক গুদামের কর্মী। এ-হেন বাবা-মায়ের সন্তান সৌরভ গত মে মাসে মধ্য কলকাতার ওই পাঁচতারা হোটেলে এসে এক রাত কাটিয়েছিলেন। সে-বার ওই হোটেলে নিজের জন্মদিন পালন করেছিলেন বন্ধুবান্ধবদের ডেকে। নগদ ৪৫ হাজার টাকা দেন হোটেলকে। পুলিশের ধারণা, আট ঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন ওই যুবক। এবং প্রথম দফায় বিল মিটিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল হোটেলের পরিচালকদের বিশ্বাস উৎপাদন!
এ বার অনলাইনে হোটেলের ঘর বুক করেন গত ২৭ ডিসেম্বর। তার পরে কাউন্টারে গিয়ে নিজের নাম বলায় হোটেলের কম্পিউটারে রাখা নথিতে ফুটে উঠেছিল সৌরভের নাম। সাদরেই আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রায় জামাই-আদরে তাঁকে পৌঁছে দেওয়া হয় একটি ঝকঝকে-তকতকে ঘরে। চেক-ইন করার সময় সৌরভ জানান, দিন দুয়েকের মধ্যে টাকা দিয়ে দেবেন। আপত্তি করেননি হোটেলের কর্মীরা।
সৌরভ তাঁর প্রতারণা-চাতুর্যের দ্বিতীয় কিস্তি দাখিল করেন এর পরেই। পাঁচতারা হোটেলে চেক-ইন করার সময় এখন অতিথির কাছ থেকে তাঁর ক্রেডিট কার্ডের নম্বর চেয়ে নেওয়াটাই দস্তুর। অতিথি হোটেলের কোনও সম্পত্তি নষ্ট করলে বা বিল না-মেটালে সেই কার্ড থেকেই টাকা কেটে নেওয়া হয়। হোটেল-কর্মীরা জানান, সাধারণত মেশিনে যে-ভাবে ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপ করা হয়, এ ক্ষেত্রে তা করা হয় না। যে-ব্যাঙ্কের কার্ড, তাদের সরাসরি ফোন করে সংশ্লিষ্ট কার্ডের মালিকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়। হোটেলের এক অফিসারের কথায়, ‘‘আমাদের হোটেলে গণ্যমান্য, ধনী, বিদেশিরাই আতিথ্য গ্রহণ করেন। তাঁদের অবিশ্বাস করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’’
এই সুযোগটাই নিয়েছেন সৌরভ। পুলিশ জানাচ্ছে, ওই যুবকের ক্ষেত্রেও ক্রেডিট কার্ডের নম্বর চেয়ে নেওয়ার নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি মুখে একটি ক্রেডিট কার্ড নম্বর বলেছিলেন ওই পাঁচতারা হোটেলের কর্মীদের।
হোটেল সূত্রের খবর, ২৭ ডিসেম্বরের পর থেকে প্রতিদিন পেট ভরে প্রাতরাশ করে হোটেলেরই ঠিক করে দেওয়া চকচকে গাড়িতে চেপে বেরিয়ে যেতেন সৌরভ। কোথায় যেতেন, তার কোনও তথ্য নেই পুলিশের কাছে। এক অফিসারের কথায়, ‘‘নিশ্চয় শহরে ঘুরে বেড়াতেন।’’ তবে এর মধ্যে এক দিন গাড়ি নিয়ে তিনি নাকি গঙ্গাসাগরেও গিয়েছিলেন। ৩০ ডিসেম্বর রাতে তিনি প্রায় দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে শহরের উপান্তে একটি ওয়াটার পার্কে আমোদপ্রমোদ করেছিলেন বলে জেনেছে পুলিশ। সেই টাকা অবশ্য নগদেই মিটিয়ে দেন তিনি।
সৌরভ হোটেলে ফিরে আসতেন শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যার মুখে। সঙ্গে কোনও না-কোনও ললনা থাকতেন। প্রথম দিকে হোটেলের রক্ষীরা আপত্তি তোলেন। সৌরভ তখন মহিলার পরিচয় দেন নিজের বোন বলে। হোটেল-কর্তৃপক্ষ আর আপত্তি করেননি। ঘরে গিয়ে প্রতিদিন বিদেশি মদের অর্ডার দিতেন ওই যুবক। যে-সুরার একটি পেগের দাম ৭৫০ টাকা। রোজই রাত প্রায় ১টা নাগাদ নিজের ঘরে চেয়ে খাবার পাঠাতেন সৌরভ।
দিন ছয়েক পরে বিল যখন দু’লক্ষ টাকা ছুঁইছুই, টনক নড়ে হোটেলের কর্মী-অফিসারদের। সৌরভ যে-ক্রেডিট কার্ড নম্বর বলেছিলেন, তা থেকে টাকা কেটে নেওয়ার জন্য ২ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ককে অনুরোধ করা হয়। ৪ তারিখে সেই ব্যাঙ্ক জানায়, যে-ক্রেডিট কার্ডের নম্বর থেকে টাকা কাটতে বলা হচ্ছে, সেটা মোটেই সৌরভের নয়। সেই কার্ড থেকে টাকা কাটার পরে তার আসল মালিক মোবাইলে বার্তা পেয়ে বেদম কটূক্তি করেন ব্যাঙ্কের লোকজনকে। কার্ডের আসল মালিকের সঙ্গে হোটেল-কর্তৃপক্ষও কথা বলেন।
সৌরভকে পুরো বিষয়টি জানালে এবং তাঁর কাছ থেকে টাকা দাবি করলে তিনি ‘অসুস্থতা’র কথা বলেন। ৫ জানুয়ারি তাঁকে আলিপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বিল বকেয়া থাকায় হোটেলের তরফে দু’জন রক্ষী মোতায়েন করা হয় হাসপাতালে। পুলিশ জানায়, হাসপাতাল থেকে বার তিনেক পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন সৌরভ। তাঁর দামি ঘড়ি, মোবাইল ফোন জমা রেখে চিকিৎসা চালায় হাসপাতাল। কারণ, চিকিৎসার খরচ জোগানোর ক্ষমতাও ছিল না সৌরভের।
হোটেল-কর্তৃপক্ষ ১০ জানুয়ারি নিউ মার্কেট থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। ১১ তারিখ রাতে পুলিশ সৌরভকে গ্রেফতার করে। মঙ্গলবার আদালত তাঁকে ২১ তারিখ পর্যন্ত পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দেয়।
হোটেলের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমার কর্মজীবনে এমন অতিথি এই প্রথম দেখলাম।’’
কী বলছেন সৌরভের বাবা-মা?
‘‘ওকে তো অনেক দিন আগেই ত্যাজ্যপুত্র করেছি,’’ বললেন মা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy