Advertisement
১৩ নভেম্বর ২০২৪
CPM

সিপিএম ‘বিদ্যামন্দিরে’ তৈরি ছাত্রদের গুরুত্ব তৃণমূল এবং বিজেপির ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’! কেউ প্রশাসন, কেউ সংগঠনে

সিপিএমের প্রথম সারিতে থাকা নেতানেত্রীরা তৃণমূল এবং বিজেপিতে গিয়ে গুরুত্ব আদায় করে নিচ্ছেন। শুধু বাংলা নয়। ত্রিপুরা সিপিএমের মধ্যেও এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে কয়েক বছর ধরে।

Former CPM leaders are gaining importance in TMC and BJP

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৯
Share: Save:

একদা সিপিএম ছিল বঙ্গ রাজনীতির ‘বিশ্ববিদ্যালয়’। কিন্তু ভোটবাক্সে ধারাবাহিক ক্ষয় সেই ইমারতকে পর্যবসিত করেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। রাজনৈতিক ভারসাম্যের নিরিখে ‘পরিবর্তিত’ পশ্চিমবাংলায় দেখা যাচ্ছে সিপিএমের সেই ‘বিদ্যামন্দিরে’ তৈরি ছাত্ররা চলে যাচ্ছেন তৃণমূল এবং বিজেপির ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’। শুধু যাচ্ছেনই না। নতুন পাঠ্যক্রম রপ্ত করে প্রতিষ্ঠা এবং গুরুত্বও পাচ্ছেন। যার সর্বশেষ উদাহরণ আব্দুস সাত্তার। যিনি ২০০৬-২০১১ পর্যন্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারে মন্ত্রী ছিলেন। যাঁকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করেছেন।

গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ বলছে, শুধু সাত্তার নন। শুধু তৃণমূলও নয়। শাসকদলের পাশাপাশি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপিতে গিয়েও নিজেদের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ করে তুলতে পারছেন একদা সিপিএমের নেতারা।

সাত্তার অবশ্য সরাসরি সিপিএম থেকে নবান্নে যাননি। মাঝে তাঁর কয়েক বছর কংগ্রেস করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা সরাসরি সিপিএম থেকেই গিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম নাম রেজ্জাক মোল্লার। যিনি বাম আমলে দীর্ঘ দিন মন্ত্রী ছিলেন। ২০১১ সালের যে ভোটে বামফ্রন্ট সরকারের পতন হল, বুদ্ধদেব নিজে হেরে গেলেন যাদবপুরে, সেই ভোটেও জিতেছিলেন রেজ্জাক। ২০১৬ সালের আগে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি। তার পর আবার ভোটে জিতে মমতার সরকারে মন্ত্রী হন। আপাতত শারীরিক অসুস্থতায় প্রায় শয্যাশায়ী তিনি। রেজ্জাকের সঙ্গে দলে বুদ্ধদেবের ‘দ্বন্দ্ব’ ছিল সুবিদিত। বুদ্ধদেবের জমি অধিগ্রহণ নীতির কট্টর সমালোচক ছিলেন রেজ্জাক। আবার সিপিএমে বুদ্ধদেবের ‘আস্থাভাজন’ নেতা হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও তৃণমূলে গিয়ে সাংগঠনিক দায়িত্ব পেয়েছেন। ঋতব্রত এখন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি। এই তালিকায় নাম রয়েছে মইনুল হাসান, আবু আয়েশ মণ্ডলের মতো নেতাদেরও। যাঁরা এক সময়ে সিপিএমের সাংসদ ছিলেন। তৃণমূলে গিয়ে বিভিন্ন সরকারি পদ পেয়েছেন।

লাল পতাকার শিবির থেকে মতাদর্শগত ভাবে একেবারে উল্টো মেরুর বিজেপিতেও গিয়েছেন অনেক নেতা। তাঁরাও ‘প্রতিষ্ঠা’ পেয়েছেন। শিলিগুড়ির তরুণ নেতা শঙ্কর ঘোষ ২০২১ সালের ভোটের আগে সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। পদ্মশিবির শঙ্করকে দাঁড় করিয়েছিল তাঁর ‘রাজনৈতিক গুরু’ তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে। শিষ্যের কাছে হারতে হয়েছিল প্রবীণ অশোককে। সেই শঙ্কর এখন বিধানসভায় বিজেপি পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক। যিনি ছিলেন অশোকের ‘স্নেহধন্য’, তিনিই এখন শুভেন্দু অধিকারীর ‘আস্থাভাজন’।

সেই তালিকায় রয়েছেন বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী বঙ্কিম ঘোষও। যিনি ছিলেন প্রয়াত সিপিএম সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের ‘কাছের লোক’। তিনিও বিজেপি পরিষদীয় দলে শুভেন্দুর খাতায় ‘ভাল’ নম্বরে রয়েছেন। হলদিয়ার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তাপসী মণ্ডল এখন হলদিয়াতেই বিজেপি বিধায়ক। একদা বণিকমহলে সিপিএমের ‘মুখ’ শিশির বাজোরিয়া এখন বিজেপির তরফে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় রাখার দায়িত্ব সামলান। রেখা পাত্র সম্পর্কে ফিরহাদ হাকিমের ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য নিয়ে শুক্রবার শিশিরের নেতৃত্বেই বিজেপি কমিশনে নালিশ ঠুকেছে। পাশাপাশিই, শিশির দায়িত্ব পেয়েছেন বিজেপির ‘বৈদেশিক সেল’ দেখাশোনা করারও।

সিপিএমের ‘পাঠশালা’ ছেড়ে পরের পর নেতারা তৃণমূল বা বিজেপিতে যাচ্ছেন কেন? রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের জবাব, ‘‘তৃণমূল-বিজেপি মিলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই দেউলিয়া করেছে। যদি আদর্শবোধ থাকে, তা হলে কেউ ভিন্ন মতাদর্শের দলে গিয়ে গুরুত্ব পেতে পারেন না।’’ আবার তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের যুক্তি, ‘‘সিপিএমের নৌকো থেকে তো ওদের ভোটারেরাই লাফ দিচ্ছেন। ফলে নেতারাও লাফ দিচ্ছেন।’’ সেই সঙ্গে কুণালের এ-ও ব্যাখ্যা, ‘‘২০১১ সালে হারার পরে সেনাপতি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন! তখন থেকেই সিপিএমের ক্ষয় শুরু।’’ রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘বিজেপিতে যাঁরা আসেন, তাঁরা সকলেই গুরুত্ব পান। দল সকলকেই সমান চোখে দেখে। তৃণমূলের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। কারণ, তৃণমূল নিজেই দল ভেঙে এবং ভাঙিয়ে তৈরি হওয়া দল।’’

কিন্তু এই প্রবণতাকে শুধু বঙ্গ সিপিএমের নিরিখে দেখতে চাইছেন না অনেকে। কারণ, এই প্রবণতা দেখা গিয়েছে ত্রিপুরাতেও। সিপিএম নেতা রেবতীমোহন দাস বিজেপিতে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ত্রিপুরার পালাবদলের ভোটের প্রাক্কালে তিনি যোগ দেন পদ্মশিবিরে। তিনি ভোটে জিতে শুধু বিধায়ক নন, বিধানসভার স্পিকারও হন। যদিও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের সঙ্গে আকচাআকচির কারণে স্পিকার পদ মধ্যমেয়াদেই ছেড়ে দেন রেবতীমোহন। ২০১৮ সালের ভোটের পরে ত্রিপুরার খোয়াইয়ের সিপিএমের জেলা সম্পাদক বিশ্বজিৎ দত্তও বিজেপিতে শামিল হয়েছিলেন।

যে উদাহরণ বলছে, যেখানে যেখানে সিপিএম টানা দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতায় ছিল, সেখানে সিপিএমের ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ভেঙে পড়েছে। পর্যবসিত হয়েছে প্রাথমিক স্কুলে। গত নির্বাচনের নিরিখে ত্রিপুরা বিধানসভায় তৃতীয় শক্তি ছিল সিপিএম। প্রথমে প্রধান বিরোধী দলেরও মর্যাদা পায়নি তারা। পরে তিপ্রা মথা বিরোধী শিবির থেকে সরকারে যোগ দেওয়ার পরে সিপিএম বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। আবার এই প্রবণতা সে ভাবে নেই সিপিএম শাসিত কেরলে। কারণ, সেখানে সিপিএম টানা দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকেনি। কেরলে সিপিএম ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী— দুই ভূমিকাতেই থেকেছে। ফলে বাংলা এবং ত্রিপুরায় সিপিএমের মধ্যে যে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ কায়েম করার মনোভাব দেখা গিয়েছিল, তা কেরলে নেই। দলের একাধিক প্রবীণ নেতা মানছেন, ‘‘আমরা যেখানে টানা সরকারে থেকেছি, সেখানে আমরা দলকে কেবল সংসদীয় রাজনীতির নিরিখেই পরিচালনা করেছি। মতাদর্শগত বুনিয়াদি শিক্ষা দিতে পারিনি। তারই ফল ভুগতে হচ্ছে।’’ আবার এর উল্টো মতও রয়েছে। সেই অভিমত বলছে, বাংলায় দলের এই দুর্দিনেও অনেক তরুণ-তরুণী দলের সর্ব ক্ষণের কর্মী (হোলটাইমার) হচ্ছেন। এই ‘বাস্তবতা’ও অস্বীকার করা যায় না।

তবে এরই পাশাপাশি এ-ও সত্য যে, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তরুণ-তরুণীদের এগিয়ে দিয়েও ‘রক্তক্ষরণ’ রোধ করতে পারছে না। একটির পর একটি নির্বাচন চলে যাচ্ছে। কিন্তু সিপিএম খাতা খুলতে পারছে না। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর সিপিএম বিভিন্ন ভাবে নিজেদের ‘সংহত’ করেছে। দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়ে যত্নবান হয়েছে। নেতৃত্বে সেলিমের মতো ‘গতিশীল’ নেতাকে এনেছে। ইত্যবসরে তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এক শ্রেণির মধ্যে ‘জনমত’ গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নিয়ম মেনেই। কিন্তু সিপিএম তার রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। অনেকের মতে, সমস্যা সিপিএমের নয়। সমস্যা কমিউনিজ়মের। সারা পৃথিবী থেকেই কার্যত কমিউনিজ়মের পাট উঠে গিয়েছে। চিন বা ভিয়েতনামের মতো যে সব দেশের দল এখনও নিজেদের ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ বলে, তারাও বামপন্থী আদর্শ সে ভাবে ধরে রাখেনি। যদিও এ দেশে এখনও সিপিএম পলিটব্যুরো ইত্যাদির মতো পুরনো বামপন্থী কাঠামো ধরে রেখেছে! ফলে আলিমুদ্দিন লড়াই করছে ইতিহাসের সঙ্গে। কিন্তু ‘ব্যর্থ’ লড়াই জেনে যোদ্ধারা একে একে শিবির পাল্টাচ্ছেন।

অন্য বিষয়গুলি:

CPM BJP TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE