জ্যোতি বসু পেরেছিলেন। পাঁচ বছর পরে সম্ভবত সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চলেছেন তাঁরই ভাবশিষ্য হাসিম আব্দুল হালিম!
তৎকালীন বাম সরকারের বিরুদ্ধে ‘বয়কটে’র নীতি ছে়ড়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবুর স্মরণে বামেদের সঙ্গে একমঞ্চে গিয়েছিল তৃণমূল। রাজ্য বিধানসভায় রেকর্ড ২৯ বছর স্পিকারের দায়িত্ব পালন করে-যাওয়া হালিমকে স্মরণের ক্ষেত্রেও একই রকম সেতু বন্ধনের উদ্যোগ গতি পেয়েছে। সিপিএম নেতৃত্ব তাঁদের তরফে রাজনৈতিক স্মরণসভায় তৃণমূল নেতৃত্বকেও আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমন্ত্রিত হলে সেই মঞ্চে প্রাক্তন স্পিকারকে শ্রদ্ধা জানাতে যেতে এখনও পর্যন্ত আপত্তি নেই শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বেরও। আবার বিধানসভায় তাঁর পূর্বসূরির প্রতিকৃতি বসিয়ে স্মরণ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করেছেন বর্তমান স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশ জুড়ে পরমত অসহিষ্ণুতার আবহে এ রাজ্যে দুই যুযুধান রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে সৌজন্যের আবহ তৈরিতে সহায়ক হয়েছেন সদ্যপ্রয়াত হালিম!
সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত, হালিমের স্মরণসভা হবে ১৮ নভেম্বর। অনেক বেশি লোককে জায়গা করে দেওয়ার জন্য সেই সভা কোনও প্রেক্ষাগৃহে না করে খোলা ময়দানে করতে চাইছেন সিপিএম নেতৃত্ব। ঠিক যেমন জ্যোতিবাবুর স্মরণসভা হয়েছিল শহিদ মিনার ময়দানে। এ বার সিপিএমের প্রাথমিক লক্ষ্য, মৌলালির রামলীলা ময়দানে স্মরণসভার জন্য কলকাতা পুরসভার সম্মতি আদায় করা। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের কথায়, ‘‘যাঁকে যাঁকে আমন্ত্রণ করা সম্ভব, তাঁদের সবাইকেই আমরা ডাকব। বামফ্রন্টে আলোচনা করে আমন্ত্রিতের তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।’’ বাম শরিকদের মধ্যে অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠেরই মত, হালিমের ‘রাজনৈতিক মর্যাদা’ মাথায় রেখে জ্যোতিবাবুর মতো তাঁর ক্ষেত্রেও শাসক দলের নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানানো হোক। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম আবার ঠিক করেছে, হালিমের দীর্ঘ দিনের নির্বাচনী কেন্দ্র আমডাঙায় তাঁর স্মরণে সভা হবে ২০ নভেম্বর। দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নেপালদেব ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘সভার উদ্যোক্তা হবে বামফ্রন্ট। তবে বামফ্রন্টের বাইরে সব রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন ব্যক্তিকেই আমরা উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করব।’’
সৌজন্যের বাতাবরণ সৃষ্টির আগে পর্দার আড়ালে অবশ্য বরফ গলানোর ছোট্ট একটি প্রক্রিয়া ঘটে গিয়েছে! যার নেপথ্যে সক্রিয় ছিলেন স্পিকার বিমানবাবু এবং রাজ্যের দুই বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সাড়ে তিন বছর আগে বর্ধমানে একটি মিছিলে হামলায় নিহত হয়েছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা। তাঁর দেহ কলকাতায় নিয়ে আসা হলেও বিধানসভার দরজা সে দিন খোলেনি! বিধানসভার ফটকের সামনে শববাহী গাড়ি রেখে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন হালিম-সহ বাম নেতৃত্ব। ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন প্রাক্তন স্পিকার। তাঁর উপস্থিতিতেই সেই সময় স্বতঃস্ফূর্ত মত উঠে এসেছিল, প্রাক্তন বাম বিধায়কদের কেউ প্রয়াত হলে মরদেহ আর বিধানসভার দিকে যাবে না! ইতিমধ্যে বামেদের নামী প্রাক্তন বিধায়ক বলতে বিনয় কোঙার, সাধন গুপ্তের মৃত্যুর পরে তাঁদের দেহ আর বিধানসভায় যায়নি। কিন্তু হালিমের শেষ যাত্রা পূর্ণ মর্যাদায় বিধানসভা ছুঁয়ে গিয়েছে।
কারণ, প্রাক্তন স্পিকারের মৃত্যুসংবাদ পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন পার্থবাবু। হাজির হয়েছিলেন সুব্রতবাবুও। হালিমের কাছে তাঁরা যে ‘ব্যক্তিগত ভাবে ঋণী’, দু’জনেই তা গোপন করেননি। এর পরে স্পিকার বিমানবাবু গিয়ে সরাসরিই হালিমের পরিজন এবং সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে নেন, যাতে মরদেহ বিধানসভায় আনা হয়। বিধানসভার সচিবালয়ের কর্মীদের আবেগের কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। এর পরে আর হালিমের স্মরণসভায় শাসক পক্ষকে ব্রাত্য করে রাখার যুক্তি নেই বলেই মনে করছে বাম শিবিরের বড় অংশ। আর পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থবাবু সরাসরিই বলছেন, ‘‘হালিমসাহেব অন্য মানুষ ছিলেন। তাঁর স্মরণসভায় ডাক পেলে আমি যাবই! বিধানসভায় কিছু করার জন্যও প্রস্তাব দেব।’’
সেই ভাবনা অবশ্য ভেবে ফেলেছেন স্পিকার বিমানবাবু। রেকর্ড ঘেঁটে তিনি দেখেছেন, জ্যোতিবাবু প্রয়াত হওয়ার পরে তাঁর প্রথম জন্মদিনে বিধানসভার লবিতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর তৈলচিত্র বসিয়েছিলেন তৎকালীন স্পিকার হালিম। গণ্যমান্যদের ডেকে সে দিনই আলোচনাসভা হয়েছিল। সেই পথেই হালিমের প্রতিকৃতি বিধানসভায় বসাতে চান বিমানবাবু। কিন্তু তাঁর জন্মদিন আসবে পরের বছর বিধানসভা নির্বাচনের পরে! তার আগে কিছু করা যায় কি না, তা-ও ভাবছেন বর্তমান স্পিকার। বিমানবাবুর কথায়, ‘‘ওঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলব। তাঁদের আপত্তি না থাকলে জন্মদিনের আগেই কাজ করে ফেলা যেতে পারে।’’
প্রয়াত হালিমই এখন সৌজন্যের সেতু!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy