ফরজানা আলমের ছেলে সাজিল। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
লোকে লোকারণ্য তেতলার ফ্ল্যাটটা নিজের বাড়ি বলে এখন মনেই হচ্ছে না তার।
অথচ চটির স্তূপের কিনারে সদর দরজার নেমপ্লেটে তার বাবা-মায়েরই নাম লেখা। ঘরে ঢুকেই নাক বরাবর দেওয়ালে ফটোফ্রেমে হাসিমুখে মা। ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে যাঁর নামের আগে বরাবরের মতো ‘প্রয়াত’ শব্দটা খোদাই হয়ে গিয়েছে।
কলকাতা পুরসভার সদ্য প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র, ফরজানা আলমের ছেলে সাজিল মুখচোরা কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে এ ঘর-ও ঘর করে চলেছে। ‘‘বাচ্চাটার দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না!’’ মঙ্গলবার দুপুরে কেঁদে বলছিলেন পরভিন বেগম। ব্রাইট স্ট্রিটের বাসিন্দা ওই তরুণী তৃণমূল কর্মী, কয়েক মাসে ফরজানার ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন। সোমবার সন্ধ্যায় ফরজানার অসুস্থতার সময়েও ও-বাড়িতে ছিলেন পরভিন। তিনি বললেন, ক্লাস সেভেনের পড়ুয়াকে মা চলে যাওয়ার খবরটা কী ভাবে দেওয়া হবে ভাবতেই আত্মীয়েরা হয়রান হচ্ছিলেন।
দু’বছর আগে সাজিলের বাবা আব্দুল মোমেনও মারা যান পথ দুর্ঘটনায়। মায়ের রাজনীতিক জীবনের ব্যস্ততা ছোট থেকেই দেখতে অভ্যস্ত ছিল সাজিল। বাবা অন্ত প্রাণ ছিল ছেলেটা। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পরে মা-ছেলে দু’জনেই দু’জনকে আঁকড়ে ধরছিলেন। ‘‘ফরজানা আপা ভোটে হারার পরে ছেলেকে আরও বেশি সময় দিতে পারতেন!’’ বলছিলেন এক আত্মীয়। কিন্তু সে আর হল কই?
কার্যত সব-হারানো বালক এখন নিজের ফ্ল্যাটেই দ্বিধা মেশানো পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল, মা তো দিব্যি সেরে উঠছে। এমনটা হতে চলেছে, কখনও ভাবেনি সে।
গত ক’টা দিন মায়ের অসুস্থতার সময়ে শাসক দলের নেতারা বড় একটা এ মুখো হননি। ভোটে হারের পরে গত ৩০ এপ্রিল বন্ধের দিনে দলীয় কর্মীদের ফরজানা নিগৃহীত হন বলে অভিযোগ। শরীরে-মনে জখম মহিলা হাসপাতাল থেকে ফিরে বাড়ির বাইরে বড় একটা যেতেন না। শেষ ক’দিন তাই খানিকটা মায়ের কাছ ঘেঁষেই থাকতে পেরেছিল ছেলে। সোমবার সন্ধেয় মগরিবের নমাজের পরে চা খেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই গল্প করছিলেন ফরজানা। একটু পরে তিনিই ছেলেকে বকে-ঝকে পাড়ার সেলুনে চুল কাটতে পাঠান। ফরজানাকে দেখে তখনও কেউ আঁচ করেননি, তাঁর শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে।
পরভিন বলছিলেন, সাজিল চুল কাটতে যাওয়ার একটু পরেই বুকে ব্যথা শুরু হয় ফরজানার। বৃদ্ধা মাকে ডেকে বলেন, ‘আমার ছেলেটাকে তোমরা দেখো।’ তার পর নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে বলে কলমা পড়তে শুরু করেন। ‘‘গাড়িতে যাওয়ার সময়েই আপার মুখটা ঢলে পড়ল। সাজিলের সঙ্গে আর দেখা হয়নি ওর মায়ের।’’ রাত পর্যন্ত সাজিলকে কী হয়েছে, জানতেই দেননি আত্মীয়েরা। শুধু বলা হয়েছিল, মায়ের শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে। কিন্তু সকালে পটনা, দিল্লি থেকে আত্মীয়েরা ভিড় করতে শুরু করার পরে সত্যিটা আর চেপে রাখা যায়নি। সকালে নার্সিংহোমে মাকে দেখতেও গিয়েছিল সাজিল। তখনই সে শুধু একবার ডুকরে কেঁদে ওঠে, জানালেন ফরজানার ছোট বোন গুনচা আলম।
তার পর থেকেই ভাবলেশহীন মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেলেটা। আশপাশের নানা কথা তার কাছে কী বার্তা বহন করছে, বোঝা যাচ্ছে না। চোখ দু’টো শুধু মাঝেমধ্যে ছলছল করে উঠছে। বাড়িতে এত ভিড়টাই সম্ভবত প্রতি মুহূর্তে তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে: মা আর ফিরবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy