ফাইল চিত্র।
চাষির ক্ষতি কী করে সামাল দেওয়া যায়, কী করে বাড়ানো যায় তার রোজগার, গত এক বছর এই জোড়া প্রশ্নের ফলায় বিদ্ধ হয়েছে ভারতের রাজনীতি। নরেন্দ্র মোদী খোঁচা খেয়ে পিছিয়েছেন — কৃষক আইন প্রত্যাহার করেছেন, পঞ্জাব হাতছাড়া হয়েছে। হয়তো হতাশা থেকেই এ বছর কৃষিতে বরাদ্দ কমেছে কেন্দ্রীয় বাজেটে। সেখানে চাষির সমর্থন ধরে রাখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎপরতা দেখার মতো। গত মে মাসে নির্বাচন জিতলেন, জুনেই ‘কৃষকবন্ধু’ অনুদান একরে ছ’হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দশ হাজার টাকা করলেন (ন্যূনতম চার হাজার টাকা)। গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ২০২১-২২ সালে চাষির ঘরে গিয়েছে রাজ্যের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। সঙ্গে ‘পিএম কিসান’ ধরলে বাংলার প্রায় চল্লিশ লক্ষ চাষি গত বছর পেয়েছেন একর-প্রতি পনেরো হাজার টাকা।
ফলে টাকা পাওয়ার হুড়োহুড়ি পড়েছে। ‘ভাগচাষি’ বলে লিখে দিলেই টাকা মিলছে, কোনও কাগজও দিতে হচ্ছে না। “এদের ক’জন সত্যিই চাষ করেন, সে প্রশ্ন থাকছেই,” বললেন এক জেলা কৃষি আধিকারিক। বছর পাঁচেক আগেও ব্যাঙ্কগুলি পশ্চিমবঙ্গে চাষি, ভাগচাষি, খেতমজুর ধরে মোট কৃষিজীবীর সংখ্যা ধরত ৭২ লক্ষ। এখন কৃষকবন্ধু প্রাপকের সংখ্যাই ৭৮ লক্ষ। সংখ্যা বাড়ার একটা কারণ বাড়তি অনুদান পাওয়ার আশায় জমি ভাগাভাগি। সরকার আগেই বকেয়া-সহ মিউটেশন ফি মকুব করেছে। সেই সঙ্গে ‘দুয়ারে সরকার’ শিবিরে মিউটেশনের আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে বলে ঘুষখোরদের উৎপাত কমেছে। জমি মালিকানার সরকারি রেকর্ড দ্রুত আপ-টু-ডেট হচ্ছে, নীতির নিরিখে যার গুরুত্ব যথেষ্ট। এই সুযোগে মেয়েদের নামে কিছু জমিও লিখে দিচ্ছে পরিবার। সামাজিক ন্যায়ের দিকে সেটা লাভ।
আশা-আশঙ্কার এই দোলাচল বাংলা ফসল বিমার ক্ষেত্রেও। বিমার আওতায় এসেছেন ৭৪ লক্ষ চাষি, বাংলার ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব। উপগ্রহ চিত্র দেখে ক্ষতির পরিমাপ করার নীতি নিয়েছে রাজ্য, তাতে কাজের গতিও বেড়েছে। এ বছর আলু তোলার কাজ শেষ হতে না-হতেই আলুচাষিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু হয়েছে। গত বছর খরিফ মরসুমে যত আবেদন হয়েছিল (মোট মূল্য ৩৯২ কোটি টাকা) তার অধিকাংশই (৩৩০ কোটি টাকা) বিলি শেষ। এ বছর বাজেটে ১০০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে প্রিমিয়াম বাবদ। সরকার প্রিমিয়াম দিচ্ছে বলে দ্রুত গ্রাহকসংখ্যা বাড়াচ্ছে বিমা কোম্পানি। কিন্তু কেবল ক্ষতি সামলাতে এত টাকা গেলে কৃষির উন্নতিতে বিনিয়োগ হবে কী করে?
সম্প্রতি দু’টি কার্যসূচি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার, যাতে চাষির আয় বাড়তে পারে। এক, আনাজ রফতানির পরিকল্পনা। দুই, সুফল বাংলা প্রকল্পের প্রসার। “রফতানি নীতি কার্যকর হলে বহু চাষি বাড়তি লাভ পাবে। তবে লক্ষ্যপূরণে ঢের দেরি,” বললেন কৃষি রফতানি বিষয়ক সরকারি কমিটি অন্যতম সদস্য, ব্যবসায়ী অঙ্কুশ সাহা। তাঁর কথায়, “যথেষ্ট বিমান, যথেষ্ট প্যাকহাউস, যথেষ্ট চাষির প্রশিক্ষণ, কোনওটাই দ্রুত হওয়ার নয়।” অন্য দিকে, ‘সুফল বাংলা’ চাষি ও ক্রেতা, উভয়কেই ন্যায্য দাম দিচ্ছে। কিন্তু মাত্র লাখদুয়েক চাষি এই প্রকল্পে যুক্ত, চাষির হাল বদলাতে হলে মমতা-ঘোষিত পাঁচশো দোকান নির্মাণের লক্ষ্যও অকিঞ্চিৎকর। ফড়ে হঠিয়ে চাষিকে বেশি রোজগার বরং দিচ্ছে ‘ফার্মার্স প্রডিউসার্স কোম্পানি।’ কিন্তু রাজ্যে চারশোর মতো কোম্পানির মধ্যে গোটা পঞ্চাশ ভাল চলছে। অদক্ষ পরিচালনার জন্য ধুঁকছে বাকিরা।
এরই মধ্যে অতিকায় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ। অতিরিক্ত তাপ, মাটির ক্ষয়, অকালঝঞ্ঝা চাষির বিপন্নতা যে হারে বাড়াচ্ছে, কেবল ক্ষতিপূরণ বিলি করে তা সামাল দেওয়া কঠিন। ভূগর্ভের জল, রাসায়নিক সার-কীটনাশক অতিরিক্ত ব্যবহারের বিপদ চাষিও বোঝে। কিন্তু বিকল্প কী? কী করে সুস্থায়ী চাষ, নিরাপদ ফসল পাওয়া সম্ভব? তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেও তার দিশা দেখাতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy