Advertisement
১২ জানুয়ারি ২০২৫
Cyber Safety

সাইবার ক্রীতদাস: বিদেশে চাকরির লোভই এদের অস্ত্র! টোপ গিললেই সটান চালান অপরাধের চোরাগলিতে

সাইবার দাসত্ব হল অপরাধ জগতের এমন এক কানাগলি, যেখানে ঢুকলে সহজে নিস্তার মেলে না। ইচ্ছা না থাকলেও হাত পাকাতে হয় সাইবার জালিয়াতিতে। আজ তৃতীয় কিস্তি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ। গ্রাফিক সহায়তা: এআই।

সৌম্যকান্তি সাহা
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:৫৮
Share: Save:

বিদেশে চাকরির সুযোগ? সঙ্গে মোটা বেতন? ভাল করে খোঁজ নিন। এটা সাইবার দাসত্বের ফাঁদ নয় তো? চাকরির টোপ দিয়ে বিদেশে নিয়ে গিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে পাসপোর্ট। তার পরে জোর করে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাইবার প্রতারণার কাজে। মোটা মাইনে তো দূর, কথামতো না চললে জুটছে অকথ্য অত্যাচার। যেমন হয়েছে ভাইজ়াগের রাজেশ, বেঙ্গালুরুর স্টিফেন বা চেন্নাইয়ের ওয়েসলিদের জীবনে।

রাজেশ বিবাহিত। ছোট সন্তান রয়েছে তাঁর। হাসপাতালে ২০ হাজার টাকার মাসিক বেতনের ইসিজি টেকনিশিয়ানের কাজে সংসার টানা কঠিন হচ্ছিল। এমন সময় বিদেশে চাকরির সুযোগ আসে। ডেটা এন্ট্রির কাজ। মাসে ৭০ হাজার টাকার বেতন। অফিস মায়ানমারে। রাজেশ উঠে পড়েন মায়ানমারের বিমানে। সেটাই কাল হয়েছিল তাঁর! তার পর থেকে রাজেশ হয়ে গিয়েছিলেন ‘সাইবার ক্রীতদাস’।

রাজেশ ফিরে এসেছেন। কিন্তু ভোলেননি যে, ক্রীতদাসের মতোই আচরণ করা হত তাঁর সঙ্গে। কেউ বলেন সাইবার ক্রীতদাস, কেউ বলেন ডিজিটাল ক্রীতদাস। এ হল সাইবার অপরাধের দুনিয়ার এক অন্ধকূপ। যেখানে ঢুকলে আর বেরোনোর রাস্তা নেই! হাজার হাজার তরুণ-তরুণী এর ফাঁদে পড়েছেন। রয়েছেন অনেক ভারতীয়ও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢুকে পড়েছেন। ফিরে আসতে পেরেছেন রাজেশদের মতো হাতেগোনা কয়েক জন।

সাইবার দাসত্ব সবচেয়ে বেশি চলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। কম্বোডিয়া, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড বা লাওসের মতো দেশগুলিতে। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কম্বোডিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশগুলিতে একটি চিনা সাইবার প্রতারণা চক্র সক্রিয়। প্রচুর ভারতীয় তরুণ-তরুণী ‘ভিজ়িটর্স ভিসা’য় এই দেশগুলিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। অভিবাসন ব্যুরোর হিসাবে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মে মাসের মধ্যে ২৯,৪৬৬ জন ভারতীয় নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মায়ানমার এবং কম্বোডিয়ায়। এঁদের অর্ধেকের বয়স ২০-৩৯ বছরের মধ্যে। তাঁদের এক-তৃতীয়াংশ পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র এবং তামিলনাড়ুর বাসিন্দা। ওই ৩০ হাজারের ৭০ শতাংশই নিখোঁজ হয়েছেন তাইল্যান্ডে। সন্দেহ, এঁদের বেশির ভাগই সাইবার দাসত্বের শিকার।

থাকে প্রতিদিনের ‘টার্গেট’

সাধারণত বিমানবন্দরের বাইরেই অপেক্ষা করে সাইবার প্রতারণা চক্রের লোকেরা। যাঁরা যান, তাঁদের নামের প্ল্যাকার্ড হাতে। যেন হবু অফিসের লোক নিতে এসেছে। তাঁদের সঙ্গে গাড়িতে উঠলেই বিপদের শুরু! গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ ফেরার রাস্তাও। গাড়িতে উঠতে না উঠতেই কেড়ে নেওয়া হয় পাসপোর্ট এবং অন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র। নিয়ে যাওয়া হয় সাইবার অপরাধের অন্ধকার দুনিয়ায়। এমন গোপন আস্তানায়, যা লোকালয় থেকে অনেক দূরে। যাতে পালানোর জন্য কেউ সাহায্য না চাইতে পারে। তার পরে বাধ্য করা হয় আন্তর্জাতিক সাইবার প্রতারণা চক্রের গোলামি করতে!

ডিজিটাল গ্রেফতার, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের টোপ থেকে শুরু করে ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারণা বা ‘সেক্সটরশন’— সবই চলে সেখানে। চাকরির টোপ দিয়ে নিয়ে আসা তরুণ-তরুণীদের ব্যবহার করা হয় এই প্রতারণায়। কে কোন ধরনের প্রতারণার কাজ করবেন, সেটিও স্থির করে দেওয়া হয়। ডেটিং অ্যাপ প্রতারণা বা সেক্সটরশনের জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় তরুণীদের। কর্পোরেট কায়দায় চলে প্রতারণা। থাকে প্রতিদিনের টার্গেট। পূরণ করতে না পারলে অত্যাচার। খাওয়াদাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশ্রামের তো প্রশ্নই নেই। টার্গেট পূরণ না হওয়া পর্যন্ত চলে অত্যাচার। যাঁরা ওই চক্র থেকে পালাতে পেরেছেন, তাঁরা পরে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

কেন ভারতীয়রাই ফাঁদে

আন্তর্জাতিক সাইবার প্রতারণা চক্র জাল বিছিয়েছে ভারতেও। ডিজিটাল গ্রেফতার হোক বা অন্য কোনও প্রতারণার ফাঁদ— চালাচ্ছে আন্তর্জাতিক চক্র। তবে সম্ভাব্য ‘শিকারদের’ কাছে ফোন আসছে ভারতীয় ভাষায়। এটা ঠিক যে, এ দেশের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক প্রতারণা চক্রে যোগ দেন। কিন্তু বিশাল সংগঠিত প্রতারণা চক্রের জন্য সেই সংখ্যা যথেষ্ট নয়। সেই কারণেই জোর করে ভারতীয় তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ করা হয়। ভিন্‌দেশে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় ভারতে থাকা সম্ভাব্য শিকারের সঙ্গে কথা বলতে। হিন্দি হোক বা তেলুগু বা অন্য আঞ্চলিক ভাষা— সবের জন্যই ব্যবস্থা থাকে। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ বিভাসের মতে, ভারতীয়দের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য প্রতারণা চক্রের চাই দেশীয় ভাষায় দক্ষ কাউকে। যিনি স্বাভাবিক ভাবে অনর্গল ভারতীয় ভাষায় কথা বলতে পারেন। যাঁর কথা বলার ধরনে ফোনের ওপারে থাকা মানুষটির মনে কোনও সন্দেহ জাগবে না। সেই কারণেই ভারতীয় তরুণদের বেশি করে ফাঁদে ফেলা।

টোপ বুঝবেন কী ভাবে

বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার ইচ্ছাই হল সাইবার প্রতারকদের ‘অস্ত্র’। বিদেশে মোটা মাইনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পোস্ট করা হয় সমাজমাধ্যমে। কোথায়, কী ভাবে যোগাযোগ করবেন, তা-ও দেওয়া থাকে। সাধারণত তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে চাকরির টোপ দেওয়া হয়। অনেক সময় ডেটা এন্ট্রির কাজের জন্যও লোক চাওয়া হয়। তবে সব ক্ষেত্রেই কম্পিউটার এবং আধুনিক প্রযুক্তির বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা থাকা আবশ্যিক।

ভারতেই বেশ কিছু ভুয়ো নিয়োগ এজেন্সি রয়েছে। যাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাইবার প্রতারণা চক্রের যোগ আছে। সমাজমাধ্যমের ওই পোস্টগুলিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও ভুয়ো নিয়োগ এজেন্সির নম্বর দেওয়া থাকে। সেখানে যোগাযোগ করলে বিদেশে চাকরির স্বপ্নকে আরও সাজিয়ে-গুছিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়। ভুয়ো বাছাই প্রক্রিয়াও করা হয়। ফলে এমন কোনও লোভনীয় চাকরির পোস্ট দেখলে এড়িয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।

যাচাই করুন

সাইবার দাসত্ব বন্ধ করতে সরকার মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা শুরু করেছে। বিভিন্ন বিমানবন্দরে সচেতনতামূলক বোর্ড বসানো হয়েছে। সরকারি ওয়েবসাইটে ভুয়ো নিয়োগ এজেন্সির তালিকা রয়েছে। ওয়েবসাইটে (ইমাইগ্রেট ডট জিওভি ডট ইন) ক্লিক করে তালিকাটি দেখা যায়। বিদেশে কোনও চাকরির সুযোগ এলে তা আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না বিবেচনা করে দেখুন। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ বিভাসের মতে, বিদেশে চাকরির সুযোগ শুনেই অনেকে মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেন। তারই সুযোগ নেয় প্রতারকেরা। রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (সাইবার ক্রাইম) অঞ্জলি সিংহ জানিয়েছেন, বেশি টাকার মাইনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতীয়দের অন্য দেশে পাচার করে দেয় প্রতারকেরা। বিদেশে এই ধরনের কোনও চাকরিতে যোগ দিতে যাওয়ার আগে পুলিশ, মানবাধিকার সংগঠন বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নেওয়াই শ্রেয়। অনলাইনেও ওই সংস্থার বিষয়ে খুটিনাটি তথ্য নাড়াচাড়া করে নিতে হবে।

সাইবার দাসত্ব চক্রের ভারতীয় এজেন্টদের খোঁজে জানুয়ারিতেই দিল্লির জামিয়া নগর এলাকায় হানা দিয়েছে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু পাসবই, চেকবই, ডেবিট কার্ড এবং সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের নথি। এনআইএ সূত্রে খবর, জামিয়া নগরের এই এজেন্সি থেকে লাওসে পাঠানো হত ভারতীয় তরুণদের।

ফেরার পথ কঠিন

গোপন ডেরা থেকে পালানো কঠিন। কারণ, পাসপোর্ট বা অন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র সব থাকে চক্রের জিম্মায়। তা-ও ভারতীয় দূতাবাস থেকে বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করা হয় এই ফেঁসে যাওয়া ভারতীয়দের উদ্ধার করতে। স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে বেশ কিছু সফল অভিযানও হয়েছে কম্বোডিয়া, লাওসের মতো দেশগুলিতে। গত বছরের জুলাই মাসে ১৪ জন এবং অক্টোবরে ৬৭ জন নিখোঁজ ভারতীয়কে কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ভুয়ো চাকরির চক্রের ফাঁদে পড়েই কম্বোডিয়ায় গিয়েছিলেন তাঁরা। বেশির ভাগই উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের বাসিন্দা। গত বছরের অগস্টে লাওস থেকে উদ্ধার করা হয় ৪৭ জন ভারতীয় তরুণকে। (চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyber Crime Cyber fraud Online fraud Digital Frauds Cyber Police Station Public awareness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy