রণক্ষেত্র বারুইপুর। পাথর হাতে বিক্ষোভে সামিল হকারদের পরিবার।
ঠিক ছিল যাত্রীদের সুবিধের জন্য প্ল্যাটফর্ম থেকে বেআইনি হকারদের উচ্ছেদ করা হবে। কিন্তু শনিবার সকালে রেলের লোকজন সেই অভিযানে বারুইপুর স্টেশনে গেলে তাঁদের প্রতিরোধ করার নামে রীতিমতো তাণ্ডব চলল।
অন্তত গোটা দশেক বোমা ফাটানো হয়েছে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে। রেলের এক অফিসারকে প্ল্যাটফর্মে ফেলে বেধড়ক মারা হয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তিনি বি আর সিংহ হাসপাতালে ভর্তি। পাথর ছুঁড়ে মারা হয় ট্রেনের যাত্রীদের লক্ষ্য করে। স্টেশনে এ সব চলার ফলে বারুইপুরে ট্রেনের গতি শ্লথ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দেওয়া ও তাণ্ডব চালানোর অভিযোগটি উঠেছে তৃণমূল প্রভাবিত শ্রমিক ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়া বারুইপুর পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গৌতম দাস সাফ বলেন, ‘‘হকার উচ্ছেদ চলবে না। আমাদের নেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গরিবের উপর অত্যাচার মানবেন না।’’ গৌতম দাস হুঁশিয়ারি দেন, ‘‘যাঁরা হকার উচ্ছেদ করতে এসেছেন, তাঁরা নিজেদের ভাল চাইলে চলে যান।’’
বারুইপুর স্টেশন চত্বর বারুইপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। যার বিধায়ক বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভার স্পিকার। বিমানবাবু বলেন, ‘‘যে কোনও উচ্ছেদ অভিযান হওয়ার আগে, যাঁদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা দরকার। এই ব্যাপারে আলোচনাও করা উচিত আগেভাগে।’’
তবে রেল কর্তাদের বক্তব্য, বেআইনি হকারদের উচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে পুনর্বাসনের প্রশ্ন আসছে কেন?
রেল ও পুলিশ সূত্রের খবর, বারুইপুর স্টেশনে এ দিন সকাল সাড়ে আটটায় গোলমাল শুরু হয়। যা শেষমেশ পরিণত হয় এক দিকে থাকা রেলকর্মী ও রেল সুরক্ষা বাহিনী (আরপিএফ) বনাম হকারদের খণ্ডযুদ্ধে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হতে বিকেল তিনটে বেজে যায়। পূর্ব রেলের পক্ষ থেকে রেল পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।
সব মিলিয়ে বেআইনি হকার উচ্ছেদ অভিযান বাতিল হয়ে গিয়েছে। আর এ নিয়ে চাপান-উতোর শুরু হয়েছে পূর্ব রেল ও রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে।
রেলের বক্তব্য, শিয়ালদহ মেন লাইন, বনগাঁ ও দক্ষিণ শাখার বিভিন্ন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বেআইনি হকার বসার জেরে যাত্রীদের ঠিক মতো দাঁড়ানোর জায়গা নেই। বার বারই যাত্রীরা এই অভিযোগ জানাচ্ছিলেন রেল কর্তৃপক্ষের কাছে।
রেলের একটি সূত্রের খবর, বারুইপুর স্টেশনের চারটি প্ল্যাটফর্মে বেআইনি হকারের সংখ্যা হাজারের বেশি। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘যাত্রীদের অভিযোগ পেয়েই আমরা এগিয়েছিলাম। কিন্তু রাজ্য সরকারের সহযোগিতা না পেলে এই কাজ করা সম্ভব নয়।’’
রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা এ দিন নবান্নে বলেন, ‘‘বারুইপুর স্টেশনে হকার উচ্ছেদ করার জন্য রেল আমাদের সহযোগিতা চেয়েছিল। তবে আমরা বলি, উচ্ছেদ করতে গেলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। তাই, এখন উচ্ছেদ অভিযান করবেন না। কিন্তু ওঁরা এ দিন সকালে স্টেশনে উপস্থিত হলে গোলমাল শুরু হয়। গোটা বিষয়টি নিয়ে রেলের উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বৈঠক করবেন।’’
নবান্ন সূত্রের খবর— কাল, সোমবার রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে মেট্রো ও রেলের তিনটি ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজারকে চিঠি দিয়ে বলা হবে, এর পর থেকে সরকারের পরামর্শ ও মতামত নিয়েই যাতে এই ধরনের অভিযান করা হয়।
তবে বারুইপুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জল এত দূর গড়ালেও কয়েক দিন আগেই বালিগঞ্জ, ডায়মন্ড হারবারের মতো কয়েকটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে বেআইনি হকার উচ্ছেদ অভিযান করা হয়েছে। সে সব জায়গায় কিন্তু তেমন সমস্যা হয়নি। রেলের বক্তব্য, তখন কিন্তু হকারদের পুনর্বাসন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করা— এ সব প্রসঙ্গ ওঠেনি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, এ দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বারুইপুর স্টেশনে হকার উচ্ছেদ অভিযানের জন্য রেলের আধিকারিক, কর্মী এবং রেল সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ানেরা উপস্থিত হতেই প্রায় দেড় হাজার হকার তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের পতাকা হাতে নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান বিরোধী মিছিল শুরু করেন। বারুইপুর স্টেশনের চারটি প্ল্যাটফর্মেই স্লোগান দিয়ে ঘুরতে থাকে ওই মিছিল।
যাত্রীদের একাংশের অভিযোগ, বিক্ষোভকারীরা স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে গোটা দশেক বোমা ফাটান। ট্রেনের যাত্রীদের লক্ষ্য করে পাথরও ছোঁড়ে বিক্ষোভকারীরা।
এর মধ্যেই রেলের সেকশন ইঞ্জিনিয়ার কমল ঘোষকে প্ল্যাটফর্মে ফেলে বেধড়ক মারতে থাকেন হকারদের একাংশ।
তবে এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জানান, রিপোর্ট না-এলে বোঝা যাচ্ছে না, বোমা সত্যিই ফেটেছে কি না।
রাজ্য পুলিশের কর্তাদের ইঙ্গিত, হকার উচ্ছেদের বিষয়টি থেকে তাঁরা দূরে থাকতে চাইছেন। শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার দেবাশিস বেজের বক্তব্য, উচ্ছেদ অভিযানে রেল পুলিশ সামিল হবে না। তবে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে নজর রাখা হবে।
তবে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘জিআরপিকে অভিযানে থাকতেই হবে। তারা সহযোগিতা না করলে অভিযান বন্ধ রাখতে হবে।’’
আর ঠিক সেটাই হল!
বিক্ষোভে সামিল হকারদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ দিন বৈঠকে বসেন রেল কর্তৃপক্ষ। যদিও কোনও রফা সূত্র বেরোয়নি। বিকেলে রেল জানিয়েছে, রাজ্য সরকারের পর্যাপ্ত সহযোগিতা না-পাওয়া পর্যন্ত আপাতত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রাখা হল।
শনিবার শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy