রোদ থেকে বাঁচতে। বুধবার গিরিশ পার্কে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
উল্টোরথে দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ বুঝি কিঞ্চিৎ হুঁশ ফিরেছে প্রকৃতির! তাই রথ সোজা ছোটানোর চেষ্টা হল চৈত্রসংক্রান্তিতে। কিন্তু এ বারের গ্রীষ্ম-পরিস্থিতিতে সেটাও হয়ে দাঁড়াল তাপমাত্রার অন্য এক রকম উলটপুরাণই!!
গত কয়েক দিন ধরে মরুশহর জয়সলমেরকে গরমে টেক্কা দিচ্ছিল কলকাতা। বুধবার সেই ছবিটা বদলে গেল। গরমের লড়াইয়ে কলকাতাকে এ দিন টপকে গিয়েছে জয়সলমের।
মঙ্গলবার মহানগরের তাপমাত্রা ছিল ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বুধবার তা কমে হয়েছে ৩৯.৬ ডিগ্রি। কাকতালীয় ভাবে এ দিন মরুশহর জয়সলমেরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে হয়ে গিয়েছে ৪০.৬ ডিগ্রি!
পারদের এক ডিগ্রি পতনটুকুই চৈত্রের শেষ দিনে কলকাতার পাওনা। মঙ্গলবার কলকাতার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে পাঁচ ডিগ্রি বেশি ছিল। আবহবিদদের পরিভাষায় গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় পাঁচ ডিগ্রি বেশি হলেই সেটাকে বলা হয় তাপপ্রবাহ। সেই সূত্র অনুযায়ী মঙ্গলবারেও মহানগর-সহ দক্ষিণবঙ্গে তাপপ্রবাহ চলছিল। চৈত্র-সেলের ছাড়ের মতো বুধবার পারদ এক ডিগ্রি নেমে যাওয়ায় এ দিন খাতায়-কলমে তাপপ্রবাহ হয়নি ঠিকই। কিন্তু স্বস্তি মিলেছে কি?
না। বরং কম আর্দ্রতা এবং ‘লু’ বা গরম হাওয়ার দাপটে দিনভর জ্বলুনি সইতে হয়েছে কলকাতাবাসীকে। গরমে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে এক বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। হাওয়া অফিস সূত্রের খবর, দক্ষিণবঙ্গের অন্য কয়েকটি জেলাতেও এ দিন পারদ সামান্য নেমেছে। তবে তাপপ্রবাহ অব্যাহত আছে বাঁকুড়ায়। তীব্র তাপপ্রবাহের তালিকায় নাম তুলে ফেলেছে ডায়মন্ড হারবারও। সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০.৪ ডিগ্রি (স্বাভাবিকের থেকে সাত ডিগ্রি বেশি)-তে উঠেছে।
আজ, বৃহস্পতিবার পয়লা বৈশাখ। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে কাগজে-কলমে গ্রীষ্মকালের শুরু। তবে দুরন্ত দহন এ বার শুরু হয়েছে বসন্তের সূচনা থেকেই। হাওয়া অফিস বলছে, নতুন বছরের শুরুতেও সুখ নেই কলকাতার কপালে। অসহনীয় পরিস্থিতি তো চলবেই। পারদ মাথাচাড়া দিলে ফের শুরু হয়ে যেতে পারে তাপপ্রবাহ। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘‘রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে তাপপ্রবাহ চলবে। কলকাতা এবং লাগোয়া জেলাগুলিতে খাতায়-কলমে তাপপ্রবাহ না-হলেও জ্বালা ধরানো পরিস্থিতির তেমন কোনও বদল হবে না।’’ দক্ষিণের কপাল পুড়তে থাকলেও হাওয়া অফিস জানাচ্ছে, নতুন বছরে সুখবর পেতে পারে উত্তরবঙ্গ। বাংলাদেশের লাগোয়া উত্তরবঙ্গে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখার সৌজন্যে চলতি সপ্তাহে সেখানে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে পাঁচ ডিগ্রি বেশি না-হলে আবহবিজ্ঞান তাকে তাপপ্রবাহ বলে না। কিন্তু বাস্তবে তাপের দাপট কত, তার বিচার নির্ভর করে গাত্র-দাহের উপরেই। দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে পাঁচ ডিগ্রি বেশি না চার ডিগ্রি, থার্মোমিটার বুঝতে পারলেও সেটা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় না। পারদ স্বাভাবিক থাকলে বা দু’-এক ডিগ্রি উপরে উঠলেও জ্বলুনি প্রাণাম্তকর হতে পারে। তাই এ দিন আবহবিদ্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী মহানগরীতে তাপপ্রবাহ না-থাকলেও মানুষের দুর্দশার হেরফের বিশেষ হয়নি। ‘‘তাপমাত্রা দু’-এক ডিগ্রি কমলে বিশেষ সুরাহা না-ও মিলতে পারে। বরং গাছগাছালি কম থাকলে কিংবা দূষণের মাত্রা বেশি হলে গরমের বাড়তি জ্বালা অনুভূত হতে পারে,’’ মন্তব্য এক পরিবেশবিদের।
এই পরিস্থিতিতে চৈত্রের শেষ দিনে তাপপ্রবাহ হোক বা না-হোক, আম-বাঙালির প্রশ্ন, টানা দহনজ্বালা সইতে থাকা শরীর জুড়োবে কবে?
দিনক্ষণ জানাতে পারছেন না। তবে আবহবিদেরা বলছেন, এই নাকাল করা গরমে লাগাম টানতে পারে কেবল ঝড়বৃষ্টি। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধিও জরুরি। কিন্তু সেই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কোনও ইঙ্গিত বছরের শেষ রাত পর্যন্ত পাননি আলিপুর আবহাওয়া দফতরের আবহবিদেরা। তাঁরা বলছেন, গরমে শরীর জুড়োনোর দাওয়াই সাগর থেকে বয়ে আসা জোলো দখিনা বাতাস। এখনও তার দেখা নেই। তার বদলে এ বার দক্ষিণবঙ্গে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঝাড়খণ্ডী লু। আর জোলো হাওয়ার জোগানদার উচ্চচাপ বলয় বাংলা উপকূল ছেড়ে সরে গিয়েছে ওড়িশার দিকে। আবহবিদদের কেউ কেউ বলছেন, গরম হাওয়ার দাপটে মুশকিল-আসান উচ্চচাপ বলয় তৈরিই হতে পারছে না। নাগাড়ে গরমের ক্ষেত্রে বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে (যা কম থাকাটাই স্বাভাবিক)। তার ফলে উপরের স্তরে যেটুকু জলীয় বাষ্প ছিল, তা-ও উধাও। ‘‘এই অবস্থায় বাংলা উপকূলে উচ্চচাপ বলয় ফিরে এলে তবেই দহন-পরিস্থিতির বদল সম্ভব,’’ বলছেন এক আবহবিজ্ঞানী।
‘পলাতক’ উচ্চচাপ বলয় নতুন বছরে তড়িঘড়ি ঘরে ফেরে কি না, এখন তারই অপেক্ষা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy