রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের ইতিহাস খুব একটা ‘শান্তিপূর্ণ’ নয়। সে কথা মনে করিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া রাজীব সিংহকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করাই কি তাঁর কাছে চ্যালেঞ্জ? রাজীবের জবাব ছিল, ‘‘আমার কাছে এটা একটা কাজ। তা ছাড়া কিছুই নয়!’’ সেটা ছিল ৭ জুন। তার পর পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা, ভোটগ্রহণ, ভোটগণনা— এক মাস পাঁচ দিন পেরিয়ে ১২ জুলাই যখন কমিশনের ভূমিকা পর্যালোচিত হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে, তখন উঠে আসছে রাজীবের সেই ‘কাজ’ এই ৩৬ দিনে কী ভাবে তর্ক, বিতর্ক, আলোচনা এবং সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। উচ্চ এবং শীর্ষ আদালত থেকে রাজ্যপাল, বিরোধী দল থেকে সাধারণ মানুষ, এমনকি, বুধবার খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কমিশনের ‘ভূমিকা’ কাটাছেঁড়া করেছেন। আর সব কিছুর কেন্দ্রে যেন আবশ্যিক ভাবে আবর্তিত হয়েছেন কমিশনার রাজীব।
রাজ্য সরকারই নির্বাচন কমিশনার হিসাবে রাজীবের নাম প্রস্তাব করেছিল। রাজভবন থেকে সেই নামে সিলমোহর পেতে কিছুটা সময় লাগে। গত ২৮ মে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার পদে মেয়াদ শেষ হয়েছিল সৌরভ দাসের। নিয়মমাফিক পরবর্তী কমিশনারের নাম প্রস্তাব করে রাজ্যপালের কাছে পাঠিয়েছিল নবান্ন। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীবের নামই পরবর্তী কমিশনার হিসাবে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস প্রথমেই সেই নামে অনুমোদন দেননি। একটা নাম পাঠানোয় ওই সুপারিশে ছাড়পত্র দিতে নারাজ ছিল রাজভবন। যা নিয়ে বেশ কিছু দিন টানাপড়েন চলে। নবান্নকে আরও নাম পাঠাতে বলা হয়েছিল। রাজভবনের দাবি মেনে কমিশনার হিসাবে দ্বিতীয় নামও সুপারিশ করা হয়। রাজ্যের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদমর্যাদার অফিসার অজিতরঞ্জন বর্ধনের নাম কমিশনার হিসাবে প্রস্তাব করে নবান্ন। তবে কমিশনার হিসাবে আর কোনও নাম তারা পাঠাতে রাজি হয়নি।
পরে অবশ্য রাজীবকেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগে সম্মতি দেন রাজ্যপাল বোস। গত ৭ জুন নির্বাচন কমিশনার পদে বসেছিলেন রাজীব। এই নিয়োগ নিয়েও সরব হন বিরোধীরা। সেই আবহেই রাজীব ৮ জুন ঘোষণা করেন, ৮ জুলাই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে রাজীবের কমিশন জানিয়ে দেয়, ৯ জুন থেকে মনোনয়ন জমা দেওয়া যাবে। মনোনয়ন পর্ব চলবে ১৫ জুন পর্যন্ত। তখন থেকেই বিরোধীরা সরব। অভিযোগ, মনোনয়নের জন্য অনেক কম সময় দেওয়া হয়েছে। মাঝে একটি রবিবার পড়ে। ওই দিন মনোনয়ন জমা দেওয়া যায়নি। এ নিয়ে কমিশনে অবস্থান বিক্ষোভ দেখায় বিরোধীরা। পাশাপাশি, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আদালতের দ্বারস্থ হন।
এই আদালতই একাধিক বার কটাক্ষ করেছে কমিশনের ভূমিকাকে। সরাসরি রাজীবকেও বেশ কয়েক বার ভর্ৎসনা করেছে কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম যেমন রাজীবের উদ্দেশে বলেছিলেন, “কমিশনারের উপর কোনও চাপ থাকলে তিনি পদত্যাগ করুন! আদালতের নির্দেশ কার্যকর করতে না পারলে কমিশনারের পদত্যাগ করা উচিত। রাজ্যপাল নতুন কমিশনার নিয়োগ করবেন।” কারণ তার আগেই আদালত রাজীবকে নির্দেশ দিয়েছিল রাজ্যের সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য কেন্দ্রকে চিঠি দেওয়ার কথাও বলে আদালত। অবশেষে হাই কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আবেদন করতে এক প্রকার ‘বাধ্য’ হন রাজীব। ২২ জেলার জন্য তিনি ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে পাঠান। এ নিয়েও মামলা হয় কলকাতা হাই কোর্টে। শেষ পর্যন্ত হাই কোর্টের নির্দেশ আসে, ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করাতে হবে। তাতে রাজীবকে সম্মত হতে হয়। কেন্দ্রকে চিঠি দেওয়ার পর তারাও বিষয়টিতে সম্মত হয়েছিল।
আদালতের পাশাপাশি রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও গোটা পর্বে রাজীবের উপর ‘বিরূপ’ হয়েছেন একাধিক বার। পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যে অশান্তির আবহে রাজীবকে রাজভবনে তলব করেছিলেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনের কাজে ‘ব্যস্ত’ থাকার কারণ দেখিয়ে রাজভবনে যাননি রাজীব। এর পর রাজীবের যোগদান রিপোর্ট (জয়েনিং রিপোর্ট) নবান্নে সই না করেই ফেরত পাঠান রাজ্যপাল বোস। যা নিয়ে রাজ্য রাজনীতি নাটকীয় মোড় নেয়। এই বিতর্কের আবহেই রাজভবনে যান রাজীব। তাঁকে ‘নিরপেক্ষ’ হয়ে কাজের পরামর্শ দেন রাজ্যপাল। রাজীব অবশ্য এ সব নিয়ে বাইরে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর হয়ে রাজ্যপালকে বিঁধেছে বাংলার শাসকদল। রাজীবের পরিচিতেরা বলেন, ‘‘নিজের কাজ সম্পর্কে দারুণ ওয়াকিবহাল তিনি। তাই কখন রাজ্যপাল ডাকলে যেতে হবে, কখন যাবেন না সেটাও তিনি খুব ভাল জানেন।’’
রাজ্য নির্বাচন কমিশন পদে রাজীবের নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলাও হয় হাই কোর্টে। সেই মামলা যদিও খারিজ হয়ে যায়। ভোটে বাহিনী নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে টানাপড়েনের আবহে বিরোধীদের সমালোচনাও বাড়তে থাকে। পঞ্চায়েত ভোটের দু’দিন আগে রাজীবকে ‘রাজধর্ম’ পালনের পরামর্শ দেন রাজ্যপাল। কারণ তত দিনে রাজ্যে ভোট-পরিস্থিতিতে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে। শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’-এর প্রসঙ্গ তুলে ধরে রাজীবের উদ্দেশে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘সঠিক পদক্ষেপ করতে যদি ব্যর্থ হন, তা হলে আরবের সমস্ত সুগন্ধী আপনার ছোট হাতকে মিষ্ট করবে না। পবিত্র গঙ্গার জলে আপনার হাতের রক্ত ধোয়া যাবে না।’’ এর পর ভোটের দিন রাজ্য জুড়ে ফের হিংসার অভিযোগ ওঠে। ভোটের দিনের সংঘর্ষের বলি এখনও পর্যন্ত ১৯ জন। এই ‘রক্তপাত’-এর জন্য বিরোধীরা রাজীবকেই দায়ী করেছেন।
রাজীবের সহকর্মীরা জানাচ্ছেন, কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি নির্দিষ্ট সময়েই দফতরে আসতেন। বেরোতেনও নির্দিষ্ট সময়ে। যেমন শনিবার, পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যখন হিংসার অভিযোগ উঠেছে, সে দিনও ঠিক ১০টা ০১ মিনিটে নিজের দফতরে ঢুকেছিলেন। তার পর রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে বেরিয়েও গিয়েছিলেন। ভোট গণনার দিন, মঙ্গলবারই সেই ঘড়ি ধরেই অফিসে ঢুকেছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব। তবে ঘড়ির কাঁটা মেনে বার হননি। রাত ২টো পর্যন্ত ছিলেন নিজের দফতরেই। জানিয়েছেন, গণনার রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন তিনি। মঙ্গলবারই রাত সাড়ে ১২টা থেকে বার বার বোমা, গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে ভাঙড়। দুই আইএসএফ কর্মী-সহ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন পুলিশ কর্তা। সে সময় রাজ্য নির্বাচন কমিশনে নিজের দফতরেই বসে ছিলেন রাজীব। বুধবারও নির্দিষ্ট সময়ে অফিস ঢুকেছে রাজীব। তার পর ফের ৭টা ৩৮ মিনিটে অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন।
আর রাজীব কী করেছেন? তাঁর ঘনিষ্ঠদের সূত্রে জানা গিয়েছে, তিনি টিভি দেখা বন্ধ করেছেন। স্ত্রীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন শুধু, টিভিতে কী চলছে। রাজীবের ঘনিষ্ঠ মহল মনে করছে, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা লাগাতার অভিযোগের ভার তিনি আর বইতে পারছেন না। তাই বন্ধ করেছেন টিভি দেখা। আগের নির্বাচন কমিশনার সৌরভ দাস যেমন খবরের জন্য টিভির উপরেই ভরসা করতেন, তাঁর উত্তরসূরি রাজীব সেখান থেকে সরে এসে মোবাইলেই খবর জানার চেষ্টা করেন। তাঁর মোবাইল নম্বর পৌঁছে দেওয়া হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ভোটারদের কাছে। সেই ভোটাররা সরাসরি অভিযোগ জানিয়ে তাঁকে ফোন করেন। আর দু’টি মোবাইলে তিনি সেই অভিযোগ শোনেন। ভোটের দিন এ-ও জানিয়েছেন, যা অভিযোগ এসেছে, তার ৮০ শতাংশ নিষ্পত্তি করেছেন তিনি। তা বলে সংবাদমাধ্যম যা দাবি করছে, সব ঠিক নয়। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘‘ঘটনা হলে খবর করুন। কিন্তু কালিমালিপ্ত করবেন না। প্রয়োজনে আমার বিরুদ্ধে খবর করুন। কিন্তু কিছু ঘটনার জন্য গোটা রাজ্যের দায় আমার উপর দেবেন না। দেখাবেন না গোটা রাজ্যে এ রকম পরিস্থিতি চলছে।’’ মুখে তিনি যাই বলুন, রাজীব আসলে এই পরিস্থিতিএ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ শুনে খানিক ‘বিভ্রান্ত’ হয়ে পড়েছেন। এ কথা জানিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল। তাই বার বার স্ত্রীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, টিভিতে কী চলছে?
‘চ্যালেঞ্জ’ নয়, পঞ্চায়েত নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে করানোকে তিনি ‘কাজ’ বলে দাবি করেছিলেন। তাঁর দায়িত্বকালে ৪৫ জনের প্রাণ যাওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, নতুন নির্বাচন কমিশনার ‘সিংহ’ কি সে ‘কাজ’ দায়িত্ব নিয়ে করেছেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy