Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

দু’বছরের মধ্যেই নিজের জেলায় অনেকটা পিছিয়ে পড়লেন শুভেন্দু, পূর্ব মেদিনীপুরও তৃণমূলেরই

সারা বাংলার নজর ছিল পূর্ব মেদিনীপুরের দিকে। বিরোধী দলনেতার জেলায়, বিরোধী দলনেতার দল কি রাজ্যের শাসকদলকে কোণঠাসা করতে পারবে? না কি শুভেন্দুকে ছাড়াই এ বার জেলা দখল করবে তৃণমূল?

Image of Suvendu Adhikari

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।

অমিত রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ ১৭:৫৮
Share: Save:

পূর্ব মেদিনীপুরে ‘ভাল’ ফল করল বিজেপি। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর ফল ‘স্বস্তির’ হল না। তাঁর নেতৃত্বেই ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল বিরোধীশূন্য করে দিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদকে। শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন তার বছর আড়াই পর ২০২০-র ডিসেম্বরে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জেলায় তৃণমূলের থেকে সামান্য পিছিয়ে থাকলেও প্রায় সমানে সমানে লড়ে গিয়েছিল বিজেপি। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে সারা বাংলার নজর ছিল এই জেলার দিকে। বিরোধী দলনেতার জেলায়, বিরোধী দলনেতার দল কি তাঁর পুরনো দলকে কোণঠাসা করতে পারবে? না কি শুভেন্দুকে ছাড়াই আবার স্বচ্ছন্দে জেলা দখল করবে তৃণমূল?

ফলাফলের পর দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল শুধু পূর্ব মেদিনীপুর দখলেই রাখল না, জেলা পরিষদের ৭০ আসনের মধ্যে ৫৬টিই তাদের দখলে। বিজেপি আটকে গেল ১৪-তেই। আগের পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে দেখতে গেলে বিজেপির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিঃসন্দেহে। কিন্তু শুভেন্দুর কাছে এই ফল যে একেবারেই ‘স্বস্তিজনক’ নয়, তা সম্ভবত তিনি নিজেও জানেন।

জেলা পরিষদ ছাড়াও পূর্ব মেদিনীপুরে পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের লড়াইয়েও বড়সড় আধিপত্য বজায় রেখেছে তৃণমূল। জেলায় পঞ্চায়েত সমিতির সংখ্যা ২৫। এর মধ্যে কাঁথি-১, নন্দীগ্রাম-২ এবং শহিদ মাতঙ্গিনী— এই তিনটিতেই কেবল জয় পেয়েছে বিজেপি। এর মধ্যে কাঁথি-১ অধিকারী পরিবারের এলাকা কাঁথি শহরেরই লাগোয়া। এগরা-২ পঞ্চায়েত সমিতি ত্রিশঙ্কু। বাকি ২১টিতেই বিজয়কেতন উড়িয়েছে তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য বজায় রেখেছে শাসকদল। ২২৩টির মধ্যে ১৭৫টিতেই জয় নিশ্চিত করেছে তৃণমূল। বাকিগুলির মধ্যে বিজেপির দখলে যেমন কিছু থাকছে, তেমনই কিছু পঞ্চায়েত ত্রিশঙ্কু। এই পঞ্চায়েতগুলিতে তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে নির্দল হয়ে জয়ীরাও ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে রয়েছেন। জেলা তৃণমূলের অনেক নেতাই নিশ্চিত, এগুলির অধিকাংশ শেষমেশ তাঁদের দিকে আসবে। এমনকি, বিজেপিও এই ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েত বোর্ড নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নয়। তাদের মূল চিন্তা বরং জেতা পঞ্চায়েত ধরে রাখা।

তবে শুভেন্দুর দলকে ভাল ভাবে আটকেও সন্তুষ্ট নয় তৃণমূল। এমনটাই দাবি জেলার বিধায়ক এবং রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরির। আনন্দবাজার অনলাইনকে অখিল বলেন, ‘‘আমরা ভাল ফল করেছি। কিন্তু আরও ভাল ফল করতেই পারতাম। হয়তো কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছে বলেই সব আসনে জয় আসেনি। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় যে মুখ্যমন্ত্রীর কাজের ফসল হিসেবেই আমরা জয় পেয়েছি, তা মেনে নিতেই হবে।’’ শুভেন্দুর নাম না করে তাঁর সংযোজন, ‘‘কোন দলের কোন নেতা কী ফলাফল আশা করেছিলেন আমরা জানি না। তবে আমাদের বিরুদ্ধে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সিপিএম, বিজেপি এবং কংগ্রেস নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে জোট করেছিল। কিন্তু মানুষ দেখিয়ে দিয়েছেন যে, নীতি বিসর্জন দিয়ে ভোটযুদ্ধ জেতা যায় না।’’

তবে বিজেপির ফলাফলে আশাহত নন পূর্ব মেদিনীপুরে দলের জেলা সহ-সভাপতি প্রলয় পাল। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ফলাফল খারাপ হয়েছে, এটা আমরা মনে করি না। কারণ, এই পঞ্চায়েত ভোটের আগে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় একটি গ্রাম পঞ্চায়েতও বিজেপির ছিল না। সেখানে আমরা জেলা পরিষদে সম্মানজনক আসন নিয়ে বিরোধীদল হতে যাচ্ছি। তিনটি পঞ্চায়েত সমিতি-সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত জিতেছি। তাই এই ফলাফলকে কোনও ভাবেই খারাপ বলা যাবে না।’’

কিন্তু বিরোধী দলনেতা স্বয়ং দীর্ঘ দিন ধরে সংগঠন করেছেন যে জেলায়, সেখানে এই ফল কি সত্যিই সন্তোষজনক? বিজেপি নেতার মতে, ‘‘শাসকদলের সন্ত্রাসের কারণেই বহু জায়গায় লড়াই করেও ফল আশানুরূপ হয়নি। বিরোধী দলনেতার বিধানসভা কেন্দ্রে নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের সামসাবাদ, কেন্দেমারি, দাউদপুর পঞ্চায়েতে আমাদের প্রার্থী দিতে দেওয়া হয়নি। অনেক আসনে অবাধ ছাপ্পা হয়েছে। শুধু নন্দীগ্রামই নয়, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জুড়েই সাধারণ মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। যদি ভোট দিতে দেওয়া হত, তা হলে আমাদের ফল গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলাতেই আশাতীত হত।’’

শুধু পঞ্চায়েত ভোটের বিচারে দেখলে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ বিজেপির এক বড় লাফ। সে বার বিজেপি ‘শূন্য’ ছিল সর্বত্রই। কিন্তু এর মাঝে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। যে অধিকারী পরিবারের নেতৃত্বে তৃণমূল জেলা সংগঠন চলেছে প্রায় দু’দশক, সেই পরিবারের তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভিঘাত খুব কম নয়। শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর রাজ্যে প্রথম বড় ভোট হয় ২০২১ সালে। বিধানসভা ভোটে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বিজেপি শুধু প্রথম জেতে তা-ই নয়, ১৬টি আসনের মধ্যে ৭টি জিতে নেয় তারা। তৃণমূল পেয়েছিল ৯টি। তার পর ২০২২ সালের পুরভোটে অবশ্য শুভেন্দুর দল খারাপ ফল করে। জেলার চারটি পুরসভার চারটিই দখল করে তৃণমূল। এর মধ্যে রয়েছে কাঁথি পুরসভাও। বছরের পর বছর যার মাথায় থেকেছেন অধিকারী পরিবারের সদস্যেরা। পুরসভার পর পঞ্চায়েত ভোটেও বিজেপিকে অনেকটাই পিছনে রাখল তৃণমূল। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই আগামী বছর হতে যাচ্ছে লোকসভা ভোটের লড়াই। তৃণমূল নেতাদের দাবি, পঞ্চায়েতের ধারা বজায় থাকবে সেই ভোটেও।

এই পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল নেতৃত্বকে আলাদা স্বস্তি দিয়েছে নন্দীগ্রাম বিধানসভা এলাকায় জেলা পরিষদ আসনের ফলাফল। নন্দীগ্রাম বিধানসভার অধীনে যে ৫টি জেলা পরিষদ আসন রয়েছে, তার ফলাফলের নিরিখে ১০,৪৫৭ ভোটে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল। বিরোধী দলনেতার বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপিকে এই ধাক্কা দিতে পেরে বেশি তৃপ্ত তৃণমূল শিবির। কারণ, এই নন্দীগ্রামেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১,৯৫৬ ভোটে হারিয়ে জিতেছিলেন শুভেন্দু।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE