ইডি-র অফিসে শুভাপ্রসন্ন। সোমবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।
ছিল ১৪ কোটি, হল সাড়ে ছয়!
শাসক দলের ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য কত দামে সারদার কাছে চ্যানেল বিক্রি করেছিলেন, তা নিয়ে রীতিমতো ধন্দ দেখা দিয়েছে।
এর আগে সারদা কেলেঙ্কারিতে গঠিত রাজ্যের বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) রিপোর্ট বলেছিল, চালু না হওয়া ‘এখন সময়’ চ্যানেলটি কিনতে সারদার খরচ হয়েছিল ১৪ কোটি টাকা। তার মধ্যে চ্যানেলটির যন্ত্রপাতি এবং দু’টি স্টুডিও-র সাজসজ্জাও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছিল রাজ্য সরকারই।
অথচ সোমবার এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বেরিয়ে শুভাপ্রসন্ন দাবি করলেন, তিনি সাড়ে ছ’কোটি টাকায় চ্যানেলটি বিক্রি করেছিলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে। এর মধ্যে ৫০ লক্ষ টাকা তিনি নিজে পেয়েছেন। বাকি টাকা চ্যানেলের অংশীদারদের দেওয়া হয়েছে। খরচ করা হয়েছে চ্যানেল সংক্রান্ত অন্যান্য খাতেও।
চ্যানেল কেনার এই দু’রকম হিসেব পেয়ে বিভ্রান্ত ইডি-র তদন্তকারীরা। সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া রাজ্যের সিটের হলফনামা সত্যি নাকি চ্যানেলটির বিক্রেতা শুভাপ্রসন্নবাবুর দেওয়া তথ্য ঠিক তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। যদিও সিটের এক তদন্তকারী অফিসার এ দিন বলেন, “আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবে শুভাপ্রসন্নকে ডেকে পাঠিয়ে জেরা করিনি ঠিকই, কিন্তু ওঁর সঙ্গে কথা বলে এবং ছয় মাস ধরে বিশদে তদন্ত করে তবেই চ্যানেল বিক্রি সংক্রান্ত হিসেবটা পেয়েছিলাম। এবং সেটাই আদালতে পেশ করেছি। এখন কে কী বলছেন, জানি না!”
ইডি কর্তাদের একাংশের ধারণা, ‘এখন সময়’ চ্যানেলের কয়েক জন অংশীদারকে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন আলাদা করে সাড়ে তিন কোটি টাকা দিয়েছিলেন। তবে যন্ত্রপাতির জন্য বকেয়া ৬ কোটি টাকা তিনি মিটিয়েছিলেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। শুভাপ্রসন্নবাবু অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, সুদীপ্তর থেকে পাওয়া সাড়ে ছ’কোটি টাকা থেকেই সংস্থার অংশীদার, যন্ত্রপাতির দাম ও কর্মীদের টাকা মেটানো হয়েছিল।
ইডি কর্তারা বলছেন, এই চ্যানেল কেনাবেচা নিয়েই এ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে শুভাপ্রসন্নবাবুকে। তাঁকে ফের ডাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন তদন্তকারীরা। আজ, মঙ্গলবার শুভাপ্রসন্নবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছে আর এক তদন্তকারী সংস্থা, সিবিআই-ও। তারাও একই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে সিবিআই সূত্রের খবর।
ইডি সূত্রের খবর, শুভাপ্রসন্নবাবু ‘দেবকৃপা ব্যাপার লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন। ২০০৬-এ ওই সংস্থা তৈরির সময় তিনি তাতে ছিলেন না বলেই জেরায় দাবি করেছেন শুভাপ্রসন্নবাবু। পরে তিনি সংস্থাটি কেনেন। তাঁর স্ত্রী, মেয়েও ওই সংস্থায় ডিরেক্টর ছিলেন। তা বাদে আরও কয়েক জন ডিরেক্টর ছিলেন। কিন্তু ‘দেবকৃপা’ সংস্থাটি তিনি কার কাছ থেকে বা কত টাকায় কিনেছেন, তার নির্দিষ্ট উত্তর এ দিন শিল্পীর থেকে পাননি তদন্তকারীরা। ইডি সূত্রের খবর, মার্চেও শিল্পীকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। সে দিনের সঙ্গে এ দিনের উত্তরের কিছু অমিল রয়েছে বলে তদন্তকারীরা জানান। ইডি সূত্রের খবর, ২০০৬ সালে ‘দেবকৃপা ব্যাপার লিমিটেড’ তৈরির পরে সেটি শেয়ার কেনাবেচা সংক্রান্ত সংস্থা হিসেবেই কাজ করত। কিন্তু এমন একটি সংস্থা কেন হঠাৎ টিভি চ্যানেল তৈরি করতে গেল, তা নিয়ে তদন্তকারীদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।
ইডি-র এক কর্তা বলেন, “শুভাপ্রসন্নবাবু একাই ওই সংস্থার মালিক ছিলেন না। অন্য ডিরেক্টররা এই চ্যানেল বিক্রিতে অনুমতি দিয়েছিলেন কি না, তা-ও দেখা হচ্ছে।” তদন্তকারীদের একাংশ জানতে পেরেছেন, ২০১২-র জুলাইয়ে শাসক দলের তৎকালীন এক প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে সুদীপ্ত সেনের কাছে চ্যানেল বিক্রি করেছিলেন শুভাপ্রসন্ন। এ নিয়েও তাঁকে জেরা করা হয়েছে বলে ইডি সূত্রের খবর। যদিও বাইরে এসে শুভাপ্রসন্নবাবুর দাবি, “সুদীপ্ত সেনই চ্যানেল কেনার ইচ্ছে জানিয়েছিলেন। কোনও মধ্যস্থতাকারী ছিল না। নিজে এসেছিলেন।” কিন্তু তখন কি তিনি সারদা বা সুদীপ্ত সেন সম্পর্কে জানতেন না? উত্তেজিত হয়ে শুভাপ্রসন্নবাবু বলেন, “আমি কী ভাবে চিনব! আমার চেনার দরকারই বা কী!” শুভাপ্রসন্নবাবু এ দাবি করলেও ঘটনা হল, যে সময়ের কথা তিনি বলছেন, সে সময় সুদীপ্ত সেন, তাঁর সারদা গোষ্ঠী এবং শিল্পী নিজে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তেই ছিলেন। সারদার একাধিক সংবাদমাধ্যমও বাজারে চালু ছিল। তাই শুভাপ্রসন্নর মুখে সুদীপ্তকে না-চেনার দাবি নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই।
ইডি-র দফতরে হর্ষ নেওটিয়া।
তদন্তে গোয়েন্দারা জেনেছেন, বর্তমান শাসক দলের কয়েক জন নেতার চাপে একটা সময় সুদীপ্ত সেন একের পর এক সংস্থা কিনেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, লোকসানে চলা বা শুরু না হওয়া সংস্থাও সারদাকে বিক্রি করা হয়েছিল। শুভাপ্রসন্নবাবুও ‘এখন সময়’ নামে ওই চ্যানেল সম্প্রচার শুরুর আগেই সারদাকে বিক্রি করেছিলেন। ইডির একাংশ বলছেন, মাত্র সাড়ে ছ’কোটি টাকায় কী ভাবে চ্যানেলের সম্প্রচারস্বত্ত্ব, যন্ত্রপাতি, স্টুডিও এবং অংশীদারদের প্রাপ্য টাকা-সহ সব পাওনাগণ্ডা মেটানো যায়, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। শুভাপ্রসন্নবাবুকে এ নিয়ে জেরা করা হয়েছে। তিনি উত্তরও দিয়েছেন। “সে সবই এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে”- মন্তব্য এক ইডি কর্তার।
বেলা ২ টো নাগাদ হলদে-সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সের ইডি দফতরে আসেন শুভাপ্রসন্নবাবু। ঢোকার সময় দৃশ্যতই বিব্রত লাগছিল তাঁকে। তবে সাংবাদিকদের সামনে মুখে হাসি-হাসি ভাব আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন তিনি। দফতরে ঢোকার আগে তিনি বলেন, “জানি না কেন ডেকেছে। এক জন নাগরিক হিসেবেই এসেছি।” যদিও এর আগে মার্চেও একই ঘটনায় তিনি ইডি দফতরে এসেছিলেন।
দিন কয়েক আগে শুভাপ্রসন্নবাবুর স্ত্রী শিপ্রা ভট্টাচার্যকেও ডাকা হয়েছিল। ইডি-র একাংশের বক্তব্য, শিপ্রাদেবীর বয়ানের সঙ্গে শুভাপ্রসন্নবাবুর বয়ানের কিছু অমিল রয়েছে। সেগুলি খতিয়ে দেখছে ইডি। শুভাপ্রসন্নবাবুর ‘আর্টস একর’-এ সারদার টাকা ঢুকেছে কি না, তা-ও দেখছেন তদন্তকারীরা। ইডি সূত্রের খবর, সে কারণেই ‘আর্টস একর’-এর হিসেবও চাওয়া হয়েছে।
সারদা তদন্তে অবশ্য ‘এখন সময়’ চ্যানেলের অন্য গুরুত্ব। তদন্তকারীরা বলছেন, এই চ্যানেলেই এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন তৃণমূল সাংসদ অর্পিতা ঘোষ। ২০১৩-র ১৬ এপ্রিল তিনিই সল্টলেকের বৈদ্যুতিন কমপ্লেক্স থানায় সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কর্মীদের বেতন না দেওয়ার অভিযোগ করেন। সেটি সারদা কাণ্ডের প্রথম মামলা। অর্পিতাকেও জেরা করেছিল ইডি।
এ দিন ইডি দফতরে ডাকা হয়েছিল শিল্পপতি হর্ষ নেওটিয়াকেও। চারটে নাগাদ পৌঁছন তিনি। পরে হর্ষ জানান, শুভাপ্রসন্নবাবু তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত। কয়েক জন লগ্নিকারীকে হর্ষ তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই তাঁকে ডাকা হয়েছে।
এ দিন ইডি অফিসে জেরা করা হয় বাবুলাল বাঁকে নামে এক ব্যক্তিকে। তিনি ‘দেবকৃপা ব্যাপার লিমিটেডের’ অংশীদার বলে খবর। ইডি সূত্রের খবর, শীঘ্রই এক ছাত্র নেতা ও এক প্রবীণ সাংবাদিককে ডাকা হতে পারে।
এ দিন কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্রের ঘনিষ্ঠ বাদল ভট্টাচার্যের ছেলে সঞ্জয় ভট্টার্চাযকে জেরা করে সিবিআই। তিনি সারদার একটি সংস্থায় সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলেন। সঞ্জয়বাবু বলেন, “সিবিআই ডাকায় খুশি। আমায় সারদার কর্মী হিসেবেই ডেকে পাঠানো হয়েছিল।”
—নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy