Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

রাস্তা থেকে তুলে ধর্ষণ, খালে বালিকার দেহ

খুন-ধর্ষণ কম দেখেনি কলকাতা। মঙ্গলবারের ভোররাত দেখাল, এ শহরে রেহাই নেই বারো বছরের বালিকারও।

মেডিক্যাল কলেজে বালিকার দেহ। বুধবার দেবস্মিতা ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

মেডিক্যাল কলেজে বালিকার দেহ। বুধবার দেবস্মিতা ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:১৬
Share: Save:

খুন-ধর্ষণ কম দেখেনি কলকাতা। মঙ্গলবারের ভোররাত দেখাল, এ শহরে রেহাই নেই বারো বছরের বালিকারও।

খাস কলকাতার ব্রেবোর্ন রোডের ফুটপাথ থেকে ঘুমন্ত সেই মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে একাধিক বার ধর্ষণ করা হল চলন্ত গাড়িতে। তার পর গলা টিপে মেরে দেহটা ছুড়ে ফেলা হল খালের জলে। গাড়ির নম্বরের সূত্র ধরে বুধবার সকালে দুই অভিযুক্তের বাড়িতে যখন হানা দিচ্ছে পুলিশ, তারা তখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল। নির্বিকার মুখে দু’জনে পুলিশকে দেখিয়ে দিয়েছে, তপসিয়ার খালের ঠিক কোথায় ‘বডিটা’ ছুড়ে ফেলেছিল তারা।

পুলিশ জানাচ্ছে, এত নৃশংস অপরাধের পরেও দুই অভিযুক্তের কোনও হেলদোল না থাকাটাই তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। গুড্ডু সিংহ ও শঙ্কর সাউ নামে ওই দু’জন পেশায় একটি অ্যাপ-নির্ভর ট্যাক্সি সংস্থার চালক। একটি গাড়িই তারা দু’জনে চালাত। পুলিশ জানাচ্ছে, সেটিতেই তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও খুন করা হয় ওই বালিকাকে। বুধবার সকালে খিদিরপুরের নিত্য ঘোষ স্ট্রিটের ভাড়াবাড়ি থেকে গুড্ডু ও শঙ্করকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বয়স কুড়ি থেকে বাইশ বছর। দু’জনেরই আদতে বাড়ি বিহারে। পুলিশ মনে করছে, মদ্যপ অবস্থাতেই তারা ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে। তাদের গাড়ি থেকে মদের চারটি খালি বোতল পাওয়া গিয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, মঙ্গলবার গুড্ডু-শঙ্কর প্রথমে একটি গ্যারাজে গাড়িটিকে সারায়। তার পর সেই গাড়ি নিয়ে বেশ রাত করে বেরিয়ে পড়ে। খিদিরপুরের একটি যৌনপল্লিতে গিয়ে দু’জনে মদ খায় ও ‘ফুর্তি’ করে। সেখানে যৌনপল্লির বাসিন্দাদের সঙ্গে গন্ডগোলেও জড়ায়। রাত সওয়া তিনটে নাগাদ তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। সিসিটিভি ফুটেজের ছবি খতিয়ে দেখে পুলিশ জেনেছে, ভোররাত ৩টে ৪৬ মিনিটে তারা গাড়ি নিয়ে ডালহৌসি থেকে ব্রেবোর্ন রোড সেতুর দিকে যায়। একটু দূরে গিয়ে গাড়ি উল্টোমুখে ঘুরিয়ে আবার ডালহৌসির দিকে ফিরে আসে।

পুলিশ জানাচ্ছে, গাড়ি চালাচ্ছিল গুড্ডু। টি-বোর্ড মোড়ে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের উল্টো দিকে বাঁ দিকের ফুটপাথ ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করায় সে। রাস্তার ধারে প্রস্রাব করে। ওই ফুটপাথেই পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ঘুমোচ্ছিল বছর বারোর মেয়েটি। পাঁজাকোলা করে তাকে গাড়িতে তুলে নেয় গুড্ডু।

এনএস রোড, হেস্টিংস, এজেসি বোস রোড উড়ালপুল হয়ে এর পর গাড়ি দৌড়য় পার্ক সার্কাস চার নম্বর ব্রিজের দিকে। পুলিশ জানায়, চলন্ত গাড়িতেই বালিকাকে ধর্ষণ করে শঙ্কর ও গুড্ডু। তার পর তাদের ভয় হয়, মেয়েটি হয়তো তাদের শনাক্ত করে ফেলবে। সেই ভয় থেকেই তাকে গলা টিপে খুন করা হয়। পুলিশ সূত্রের দাবি, খুনটা করে শঙ্কর। খুনের পরেই দেহ লোপাটের জায়গা খুঁজতে থাকে দু’জন। শেষে জিজে খান রোডের ব্রিজ থেকে তপসিয়ার খালে ফেলে দেওয়া হয় দেহটি।

বুধবার খালে ডুবুরি নামিয়ে ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় বেলা ১২টা নাগাদ দেহটি উদ্ধার হয়। ময়না-তদন্তে প্রাথমিক ভাবে ধর্ষণ ও গলা টিপে খুন করার চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। সারা দেহে আঁচড়েরও অসংখ্য দাগ রয়েছে। বাজেয়াপ্ত হয়েছে গাড়িটিও। এ দিন বিকেলে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির করানো হলে বিচারক ধৃত দু’জনকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

হাওড়ার বাগনানে মেয়েটির বাড়ি। সেখানেই একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত সে। তার কয়েক জন আত্মীয় কলকাতায় কাজ করেন। মা কাজ করেন ফুটপাথের একটি হোটেলে। বাবা কয়েক বছর আগে মারা যান। এ বার সপ্তাহখানেক আগে সে পুজোর জামাকাপড় কিনতে মাসির সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল। সোমবারই তার হাওড়ায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি।

আক্ষেপ যাচ্ছে না মেয়েটির মামার। মঙ্গলবার ভোররাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনিই। বললেন, ‘‘ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ প্রাকৃতিক প্রয়োজনে উঠেছিলাম। তখন দেখলাম, ফুটপাথের ধারে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ইঞ্জিন চালু। সেই গাড়ি থেকে এক জন নেমে আমার ঘুমন্ত ভাগ্নিকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তুলছে। ভাগ্নি একটু হাবাগোবা গোছের। সেই জন্য বোধহয় ঘুম ভাঙলেও চেঁচায়নি। কিন্তু ওকে গাড়িতে তুলছে দেখে আমি চিৎকার করে উঠি।’’ তাতে ফুটপাথে শুয়ে থাকা অনেকেরই ঘুম ভেঙে যায়। তাঁরা গাড়িটিকে তাড়াও করেন। কিন্তু গাড়িটি খুব জোরে গঙ্গার দিকে চলে যায়। তখন চারটে বাজতে মিনিট দশেক বাকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশে খবর দেওয়া হয়। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, এক ফুটপাথবাসীই পুলিশকে ওই গাড়ির নম্বরটি বলেন। গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্তার কথায়, ‘‘ওই ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি প্রবল। এক বার দেখেই তিনি গাড়ির নম্বর হুবহু মনে রেখেছেন।’’

এর পরেই ওই তল্লাটে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ঘাঁটতে শুরু করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীর বলা নম্বরের সঙ্গে সিসিটিভি-র ফুটেজে দেখতে পাওয়া একটি সাদা গাড়ির নম্বর মিলে যায়। ওই নম্বরের সূত্র ধরেই বুধবার সকালে খোঁজ মেলে গাড়িটির আদি মালকিন নীতা আচার্যের। বুধবার সকালে খিদিরপুরের বাসিন্দা নীতাদেবীর কাছে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, তিনি মাস দুয়েক আগে ওই গাড়িটি দীপক সিংহ নামে এক ব্যক্তিকে বিক্রি করে দিয়েছেন। যদিও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর এখনও তাঁর নামেই রয়েছে। তাঁর কাছ থেকে দীপকের ফোন নম্বর পায় পুলিশ। দীপক পুলিশকে জানান, তাঁর গাড়িটি অ্যাপ-নির্ভর ট্যাক্সি সংস্থায় ভাড়া খাটে। দীপকের কাছ থেকেই দুই চালকের সন্ধান মেলে। পুলিশের দাবি, জেরার মুখে দোষ কবুল করে গুড্ডু ও শঙ্কর। তারা জানায়, তপসিয়ার খালে তারা দেহটি ফেলে দিয়েছে।

গোটা ঘটনার বীভৎসতায় শিউরে উঠেছেন অনেকেই। স্বাভাবিক ভাবেই মনে পড়েছে দিল্লির চলন্ত বাসে ধর্ষিতা নির্ভয়াকে। আবার তাঁর পাশাপাশিই উঠে আসছে রাজ্যের অনেকগুলো মুখ। কামদুনিতে ধর্ষিতা ছাত্রী। পরিত্যক্ত কারখানা চত্বরে ধর্ষণ ও খুনের পর ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে ডোবার ধারে যাঁর দেহটা ফেলে রাখা হয়েছিল। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ধর্ষিতা সেই কাগজকুড়ানি। শরীরে স্ক্রু-ড্রাইভার ঢুকিয়ে খোঁচানোর পর অতিরিক্ত রক্তপাতে যিনি মারা যান। তাঁকেও ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল একটি সেতুর নীচে।

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সিঙ্গুরের জমি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিনেই এই ঘটনার প্রকাশ্যে আসা মনে করিয়েছে তাপসী মালিককেও। জমি আন্দোলনে যোগ দেওয়া এই কিশোরীর আধপোড়া দেহ উদ্ধার হয়েছিল সিঙ্গুরে। অভিযোগ, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল তাঁকে। এ ছাড়া চলন্ত গাড়িতে বা ট্যাক্সিচালকের হাতে নির্যাতনের ঘটনাও কম নেই এ শহরে। তা সে বছর দুয়েক আগে হাসপাতালে স্বামীকে দেখে ফেরার পথে ট্যাক্সিতে নির্যাতিতা গৃহবধূই হোন, কিংবা চলতি বছরেরই মে মাসে সল্টলেকে গাড়িতে গণধর্ষিতা তরুণী।

গত বছর বিভিন্ন রাজ্যে হওয়া অপরাধের পরিসংখ্যানের রিপোর্ট মঙ্গলবারই প্রকাশ করেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)। তাতে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণের মামলার নিরিখে ২০১৪-য় পশ্চিমবঙ্গ ছিল দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু ২০১৫-য় নেমে গিয়েছে নবম স্থানে।

মঙ্গলবারের ভোররাত অবশ্য গুলিয়ে দিয়েছে সব হিসেব।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE