Advertisement
E-Paper

ফুরফুরা সফরে মুসলিম ভোট আরও নিশ্চিত করেছেন মমতা? ‘নতুন মুখ’ তুলে আনার চেষ্টা কি রাজনীতির পাটিগণিতেই?

একটা সময়ে ফুরফুরা বলতে পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির দাপটকেই মুখ্য ধরা হত। কিন্তু গত ১৫-১৬ বছরে ত্বহার বয়স বেড়েছে। প্রতাপ কমেছে। ত্বহার যেমন পুরনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না, তেমনই এই প্রজন্মের পিরজাদারা উঠে এসেছেন, নওশাদদের মতো যাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক খিদে রয়েছে।

Did Mamata Banerjee\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s visit to Furfura Sharif help her consolidate minority votes

গত শুক্রবার ফুরফুরা শরিফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫৭
Share
Save

ভোট এলে ফুরফুরার কথা মনে পড়ে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের। ফুরফুরা তখন তাঁদের কাছে ‘তীর্থভূমি’। পিরজাদা এবং হুজুরদের কাছে যাওয়া, সৌজন্য বিনিময়ের রেওয়াজ নতুন নয়। সেই ফুরফুরা আবার আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরের পরে। ঘটনাচক্রে, ন’বছর পরে ফুরফুরায় গেলেন মমতা। রাজ্য সরকার আয়োজিত ইফতারে মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে এমন কিছু ‘মুখ’ সে দিন ছিলেন, যাঁরা গত লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূলের প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের অন্যতম কাশেম সিদ্দিকি, যিনি ফুরফুরার পর পার্ক সার্কাস ময়দানের ইফতারেও মমতার পাশে ছিলেন।

আগামী বছর বিধানসভা ভোট। তার আগে মমতার ফুরফুরা সফরে এই প্রশ্ন অবধারিত ভাবে উঠছে যে, অতঃপর কি সংখ্যালঘু ভোট আরও একচেটিয়া ভাবে অধিকার করবেন তৃণমূলনেত্রী? কাশেমকে তুলে আনার চেষ্টা কি সেই পাটিগণিতেই?

মমতার ফুরফুরা সফর নিয়ে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘সংখ্যালঘু মানুষও বুঝতে পারছেন তাঁরা ধাপ্পার শিকার। মুখ্যমন্ত্রীও সেটা বুঝতে পেরেছেন। তাই ন’বছর পরে তাঁকে ফুরফুরা যেতে হয়েছে।’’ ফুরফুরা এলাকা শ্রীরামপুর লোকসভার অন্তর্গত। সেই শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবার বক্তব্য, ‘‘মমতাদিকে সংখ্যালঘু মানুষ পছন্দ করেন। তাঁদের সকলের নেত্রী তিনি। তাঁকে কোনও অঙ্ক কষে ইফতারে যেতে হয় না।’’ বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ীর ব্যাখ্যা, মমতার ফুরফুরা সফর এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল। তাঁর কথায়, ‘‘এক দিকে মমতা দেখছেন ববি হাকিম, সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, হুমায়ুন কবীরেরা নিজেদের সংখ্যালঘু নেতা হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন। তাই মমতা নিজে গিয়ে ওঁদের বার্তা দিয়েছেন। ভোটের আগে নিজের ব্যাঙ্ককে সংহত রাখার কৌশলেও তিনি ফুরফুরায় গিয়েছিলেন।’’

অঙ্ক যে আছে, তা মানছেন প্রায় সকলেই। শ্রীরামপুর বড় বেলুর দিক থেকে ফুরফুরা যাওয়ার পথেই পড়ে শিয়াখালা বাজার। মমতার সফরের কারণে সেই বাজার তৃণমূলের পতাকায় ছয়লাপ ছিল। সেখানেই ছোট চায়ের দোকানি প্রৌঢ় তৃণমূলের সমর্থক। এবং কোনও কথার মারপ্যাঁচে না গিয়ে তিনি বলে দিলেন, ‘‘সবাই অঙ্ক কষে। দিদি কষবে না?’’ এ কথা ঠিক যে, ২০০৯ সাল থেকেই সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের দিকে ছিল। ক্রমে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। মমতা সরকারে আসার পর থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুরের সংখ্যালঘু ভোট বাম-কংগ্রেসের দিকে থাকলেও গত ২০২১ এবং ২০২৪ সালের ভোটে তার বাক্সবদল হয়েছে। ফলে তৃণমূলের ‘পুঁজি’ আরও সংহত হয়েছে। তৃণমূলের প্রথম সারির এক প্রবীণ নেতার মতে, ‘‘বিজেপি হিন্দু ভোট এককাট্টা করার কথা বলে মেরুকরণ করছে। শুভেন্দু অধিকারীদের লক্ষ্য বাম-কংগ্রেসের দিকে এখনও যেটুকু হিন্দু ভোট রয়েছে, তা পুরোটাই বিজেপির দিকে টানা। সেই আবহে সংখ্যালঘু ভোট যাতে সামান্যও এ দিক-ও দিক ছিটকে না যায়, তার চেষ্টা তো উল্টো দিকে থাকবেই।’’

বিজেপির তরফে ধারাবাহিক ভাবে বলা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে তৃণমূলের ভোট শতাংশের ফারাক ৬ শতাংশ। অর্থাৎ, তৃণমূলের দিকে থাকা ৩ শতাংশ হিন্দু ভোট তারা টেনে নিতে পারলে আসন সংখ্যায় অন্য ছবি তৈরি হয়ে যাবে।

একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সংখ্যালঘু ভোটের প্রশ্নেই ফুরফুরা গুরুত্বপূর্ণ। সেই একই প্রশ্নে আসছে ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি এবং তাঁর দল আইএসএফের প্রসঙ্গ। ২০২১ সালের ভোটের অব্যবহিত আগে তৈরি আইএসএফ সেই ভোটে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছিল। কিন্তু ভাঙড় থেকে নওশাদ ছাড়া কেউ জিততে পারেননি। তৃণমূলেরই অনেকের মতে, ভাঙড়ে শওকত মোল্লা, আরাবুল ইসলাম, কাইজ়ার আহমেদরা নিজেদের মধ্যে কোন্দল না করলে নওশাদও জিততেন না। তবে শাসকদলের পোড়খাওয়া নেতাদের অনেকের বক্তব্য, ভোটে ‘ব্যাপক প্রভাব’ তৈরি না করতে পারলেও দুই ২৪ পরগনার বিভিন্ন কেন্দ্রে আইএসএফ ভোট কেটেছিল।

আগামী বিধানসভা ভোটে সেটাই রুখতে চাইছেন মমতা। কারণ, রাজনৈতিক মহলের মতে, ২০২১ সালের থেকেও চড়া দাগের মেরুকরণের আবহে ভোট হবে ২০২৬ সালের বিধানসভায়।

নওশাদ প্রকাশ্যে তৃণমূলের বিরোধিতা জারি রেখেছেন। নবান্নে গিয়ে মমতার সঙ্গে তাঁর বৈঠক নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। ফুরফুরায় মমতার ইফতারে তিনি থাকবেন কি না, তা নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জল্পনা ছিল। নওশাদ যাননি। তবে তাঁর ‘সমর্থক’ কাশেম গিয়েছিলেন। মমতার মঞ্চে কাশেমের উপস্থিতি নিয়ে দু’টি ব্যাখ্যা রয়েছে। এক, নওশাদই কাশেমকে পাঠিয়েছিলেন। দুই, কাশেমকে নিজের মঞ্চে টেনে মমতা নওশাদদের বার্তা দিয়েছেন ‘নতুন মুখ’ তুলে আনার। পাশাপাশি, সার্বিক ভাবে ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছেন ফুরফুরায় প্রভাবিত মুসলিম জনতাকে, যারা এখনও তৃণমূলের বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। হাওড়ার আমতার ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যুর পরে কাশেম মমতার সরকারের বিরোধিতায় সরব ছিলেন। স্থানীয় স্তরের তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে রাস্তা কাটার সময় সেখানে ছিলেন তিনি। মমতা ফুরফুরা যাওয়ার দু’দিন আগেও রাজ্যের মন্ত্রী তথা জাঙ্গিপাড়ার (ফুরফুরা শরিফ এই কেন্দ্রেরই অন্তর্গত) বিধায়ক স্নেহাশিস চক্রবর্তী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘স্নেহাশিস পাক্কা চিটার (প্রতারক)।’’ মমতা তা জানেন না বলে কেউ মনে করেন না। কিন্তু তার পরেও কাশেমকে পর পর দু’দিন মঞ্চে গুরুত্ব দেওয়া ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।

ফুরফুরা সফরের পাশাপাশি আরও কয়েকটি ঘটনাকে এক সূত্রে বাঁধতে চান তৃণমূলের অনেকে। ফুরফুরার যে অংশ রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে, তাদের নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম মাদ্রাসা শিক্ষা এবং সংখ্যালঘু বিত্তনিগম। উল্লেখ্য, এই দু’টি জায়গাতেই মমতা গত কয়েক মাসে দু’টি ‘সংস্কার’ করেছেন। বাম সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা পরবর্তী কালে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া আব্দুস সাত্তারকে মাদ্রাসা শিক্ষা বিষয়ে তাঁর উপদেষ্টা করেছেন। আবার সংখ্যালঘু বিত্ত নিগমের চেয়ারম্যান পদ থেকে আইপিএস অফিসার পিবি সেলিমকে সরিয়ে সেই দায়িত্ব দিয়েছেন ইটাহারের বিধায়ক মোশারফ হোসেনকে, যিনি দলের সংখ্যালঘু সেলেরও চেয়ারম্যান। অর্থাৎ, ২০২৬ সালের লক্ষ্যে মুসলিম ভোটকে আরও সঙ্ঘবদ্ধ করার পদক্ষেপ মমতা শুরু করেছিলেন আগেই। ফুরফুরা সফর তাতে আরও একটি সংযোজন।

কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ফুরফুরা বলতে পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির দাপটকেই মুখ্য ধরা হত, যাঁর সঙ্গে একটা সময় পর্যন্ত তৃণমূলের হয়ে সমন্বয় রাখতেন মুকুল রায়। কিন্তু গত ১৫-১৬ বছরে ত্বহার বয়স বেড়েছে। প্রতাপ কমেছে। রমজান মাসেও ত্বহার বাড়ির উঠোনে সেই ভিড় নেই। ত্বহার পুরনো প্রভাব কমার পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মের পিরজাদারা উঠে এসেছেন, নওশাদদের মতো যাঁদের রাজনৈতিক খিদে রয়েছে। এই বন্ধনীতে অনেকে কাশেমকেও রাখছেন।

ফুরফুরার অদূরেই রাজবলহাট। সেখানে একটি কৃষিপণ্যের দোকান চালান এক প্রাক্তন সিপিএম নেতা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফুরফুরার সাধারণ মুসলিমদের ক্ষোভ রয়েছে। এটা যেমন বাস্তব, তেমনই বাস্তব এটাও যে, বিজেপি যত হিন্দুত্ব নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হবে, সংখ্যালঘুরাও তত পাল্টা শিবির খুঁজবেন। মমতা চেষ্টা করেছেন নিচুতলার ক্ষোভের প্রভাব যাতে বড় ভোটে না পড়ে।’’

CM Mamata Banerjee Furfura Sharif Twaha Siddiqui

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}