মইগ্রামে অজয় সিংহর তৈরি সেই হাট। ছবি: মোহন দাস।
উদ্যোগটা ছিল এক সামান্য দিনমজুরের। তাঁর সেই উদ্যোগের সাফল্যেই আজ গ্রামের মানুষ পেয়েছেন হাট। বেচাকেনা করতে পারছেন নিজেদের জিনিসপত্র। ন্যায্য দামে কেনাকাটা করতে পারছেন গ্রামের মানুষ।
বছর ছয়েক আগের কথা। আরামবাগের তিরোল পঞ্চায়েতের মইগ্রামের বাসিন্দা অজয়কুমার সিংহর মাথায় চেপে বসল অদ্ভূত খেয়াল। এলাকায় কোনও হাট নেই। গ্রামের লোকজন এমনকী তাঁকেও অনেক দূরে গিয়ে বাজার-হাট করতে হয়। গ্রামের মানুষের অসুবিধার কথা ভেবে ঠিক করলেন গ্রামে হাট বসাবেন। সামান্য দিনমজুর অজয়ের এমন খেয়ালে প্রথমে কেউ আমল দেননি। স্ত্রী শ্যামলী দেবীও স্বামীর এমন ইচ্ছা শুনে চিন্তায় পড়ে যান। কিন্তু নাছোড় অজয়। কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন কাজে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রামের মানুষকে বোঝালেন গ্রামে হাট থাকার প্রয়োজনীয়তা। গ্রামে হাট থাকলে সকলে কেনাকাটা করতে পারবেন কম দামে। নিজের ফসল নিজে সরাসরি বিক্রি করে দু’পয়সা লাভেরও মুখ দেখা যাবে। শুধু তাই নয়, নিজেই ঢ্যাড়া পিটিয়ে শুরু করে দিলেন হাটের পক্ষে প্রচার। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাটের পক্ষে মানুষকে সইও করাতে শুরু করলেন। গ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষকে নিয়ে হাটের খরচের জন্য চাঁদা সংগ্রহে নামলেন। শ্যামলীদেবীর কথায়, “দিন আনি দিন খাই পরিবার। ৬০ বছর বয়সে ওঁকে এ সব করতে দেখে ভাবতাম মাথাটা বোধহয় বিগড়ে গিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দু’মাসের মধ্যে ও গ্রামে হাট বসিয়েই ছাড়ল।”
২০০৮ সালের গোড়ায় হাট বসতে শুরু করল মইগ্রামে। অজয়বাবুর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায় জেলা প্রশাসনও। বছর খানেক আগে মারা গিয়েছেন তিনি। কিন্তু মইগ্রামের হাট এখন জমজমাট। অন্তত ১০-১২টি গ্রামের মানুষের কাছে এই হাট এখন কম দামে জিনিস কেনারও একমাত্র ক্ষেত্র, নিজের জমির ফসল বিক্রি করে রুটি রুজিরও জায়গা।
মইগ্রাম আরামবাগ শহর থেকে প্রায় ৮ কিমি পথ। আরামবাগ বাজারে তুলনামূলক বেশি দাম হওয়ায় আগে মইগ্রামের মানুষকে হাট করতে যেতে হত প্রায় আট কিলোমিটার দূরের বাতানল গ্রামে। অবশ্য কাছে চার কিলোমিটার দূরে তিরোল গ্রামের হাট থাকলেও ২০০৪ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় মইগ্রামের হাট এতটাই জমেছে যে প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার কম দামে বাজার করতে ভিড় করেন আরামবাগ শহরের মানুষও।
অবশ্য হাটের জন্য জায়গা নির্বাচনের পর্ব সহজ হয়নি। বর্তমানে যেখানে হাট বসে সেটি খেলার মাঠ হওয়ায় বাধা আসে। কিন্তু গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের ইচ্ছায় সেই বাধা কাটে। অবশ্য সেখানেও অবদান রয়েছে অজয়বাবুর। মাঠ লাগোয়া নিজের ১৫ শতক জমি তিনি হাটের জন্য দান করেন। গ্রামবাসীদের নিয়ে একটি হাট কমিটি রয়েছে। কমিটির সম্পাদক তথা অজয়বাবুর ভাইপো রঞ্জিত সিংহ বলেন, “হাটে কারবারীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, কাকা যখন হাট পত্তন করেন তখন প্রথম দিনই ২৮ জন হেটো এসেছিলেন। বাড়তে বাড়তে এখন গড়ে প্রতি হাটে ৮০ থেকে ৯০ জন হাজির হন। সস্তায় মাছ ও সবজি কিনতে আরামবাগ পুরসভা এলাকার মানুষও হাজির হন এখানে।” হাট কমিটিতে রয়েছেন শ্যামলীদেবীও। হাট পরিচালনার দায়িত্ব তাঁকেই দিয়েছে কমিটি।
শ্যামলী দেবী জানান, প্রতি হেটোর কাছ থেকে হাট পিছু ২ টাকা করে নেওয়া হয়। সেই টাকা খেলার মাঠ এবং হাটের পরিকাঠামোর উন্নয়নে খরচ করা হয়। গ্রামে বিভিন্ন উৎসবে এবং দুঃস্থ পরিবারকে সাহায্য করা হয়। হাটে পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকলেও অভাব রয়েছে শৌচাগারের। শ্যামলীদেবী জানালেন, শীঘ্রই সেই কাজেও হাত দেওয়া হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy