কৃষ্ণনগরে হোলুই গানের আসর। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
অঘ্রানের পড়ন্ত বিকেল।
নদিয়ার কৃষ্ণপুর গ্রামে এক গেরস্থ বাড়ির উঠোনে চলছে গানের মহলা। তেলচিটে বাঁধানো খাতায় কাঁচা হাতে লেখা কয়েকটা লাইন।
জনা আটেকের দল। চড়া স্কেলের হারমোনিয়ামে সুর তুলছেন দোহারা চেহারার এক জন। তীক্ষ্ণ গলায় গান ধরেছেন মূল গাইয়ে। সঙ্গে বাজছে খোল, করতাল, বাঁশি—
‘শুনুন, শুনুন, ভারতবাসী শুনুন দিয়া মন/ আজ এই আসরে বাতিল নোটের কথা করিব বর্ণন/ দেশ বিদেশের কালো টাকায় ছেয়ে গেল দেশ/ কালোবাজারি, হাওলাপার্টি চালাচ্ছিল বেশ/ (তাঁর) রাতদুপুরে হঠাৎ করে ভেঙে গেল ঘুম/ শুরু হল পাঁচশো টাকা হাজার টাকার নোট বাতিলের ধুম।’
সমবেত কণ্ঠে ধুয়ো— ‘ওগো নোট বাতিলের ধুম, আহা নোট বাতিলের ধুম’। উদ্দাম হল খোল-করতাল। চারপাশ থেকে ভিড় গলা মেলাল— ‘হোল বোল, হোল বোল’।
এই ‘হোল বোল’ থেকেই নদিয়ার নিজস্ব এই গানের নাম ‘হোলুই’। আদিতে কৃষ্ণকথা হলেও এখন গানের আসল কাজ হল আশপাশে ঘটে চলা নানা ঘটনা, অন্যায়-অবিচারের কথা অকপটে তুলে ধরা। কোনও রূপক বা উপমার আড়ালে নয়, সোজাসাপটা। সিঙ্গুর থেকে কামদুনি, নারী নির্যাতন থেকে লগ্নি সংস্থার ফাঁদ— সমকালীন সব কিছুই চলে আসে গানের কথায়। ঠিক যে ভাবে একশো বছর আগে বাঁধা গানেও ধরা রয়েছে গাঁয়ের বধূর রোজনামচা থেকে পণ-যাতনার কথা।
আঞ্চলিক ইতিহাস বলছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই কৃষ্ণগঞ্জ, শিবনিবাস, কৃষ্ণপুরের গাঁয়ে-গাঁয়ে গোটা পৌষ জুড়ে হোলুই গান গাওয়া হয়। এক মাস ধরে রোজ বাড়ি-বাড়ি গান শুনিয়ে গায়কেরা জোগাড় করেন চাল-ডালের ‘সিধে’। পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন, পয়লা মাঘ গ্রামের বাইরে কোনও মাঠে গিয়ে সেই চালে-ডালে হয় বনভোজন।
এ বার যখন হোলুইয়ের মহলা সবে শুরু হব-হব, ঠিক তখনই নোট বাতিলে নাস্তানাবুদ জনতা। স্বাভাবিক ভাবেই গানের কথায় চলে আসছে—
‘কত নোট পুড়ে গেল/ নদীর জলে ভেসে গেল/ দেশে এল নোটের আকাল/ একশো সাতাশ কোটি ভারতবাসী হল যে নাকাল/ তাই তো বলি, এ বার বুঝি যায় গরীবের প্রাণ/ বল কত দিনে হবে এ যাতনার মুশকিল আসান।’
কারা লিখছেন, কারাই বা গাইছেন এই মেঠো গান?
কেউ খেতমজুর, কেউ বা নিছকই রাখাল। বাসুদেব ঘোষ রিকশা চালান, নারায়ণ ঘোষের মুদির দোকান। ওঁদের সঙ্গে আবার স্বচ্ছল চাষি সুমন ঘোষও আছেন। তাঁর বাবা ছিলেন এক সময়ের নামী হোলুই গায়ক অজিত ঘোষ। সুমন বলেন, ‘‘আমাদের গানে কাউকে খুশি করার চেষ্টা নেই। সে কালেও রাজা বা জমিদারেরা হোলুই গায়কদের পছন্দ করতেন না। গান শুনে খুশি হয়ে কেউ আমাদের বাপ-কাকাদের টাকাকড়ি দিয়েছেন, কোনও জন্মেও শুনিনি। এখনও তাই।” সেটা সত্যিই। লোকশিল্পী হিসেবে হোলুই গায়কদের কোনও স্বীকৃতি নেই। মেলাখেলায় ডাকও পান না। তবে গাইছেন কেন? বাসুদেব হাসেন, “স্বীকৃতি নেই তো নেই! তাতে গানটা তো থেমে যায়নি। গাঁয়ের মানুষ এই জীবনযন্ত্রণার গান শোনার অপেক্ষায় থাকেন আজও। আর কী চাই?”
‘হীরক রাজার দেশে’র চরণদাস গাইয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy