—ফাইল চিত্র।
তখন বার্লিন ওয়াল ভেঙেছে, বাবরি মসজিদ ভাঙেনি। আমার পথের শেষ যে কবির বাড়িটিতে, সেখানে এক দিন গিয়ে দেখি, তিনি ভিতরের ঘরে, বাইরের ছোট বইঠাসা বসার ঘরটিতে হাফ হাতা শার্ট আর প্যান্ট পরা এক অতিশয় ভদ্রলোক মন দিয়ে কোনও একটা লিটল ম্যাগাজ়িন পড়ছেন। মিষ্টি করে হাসলেন। থতমত খেয়ে একটু হেসে এক কোণে বসে অপেক্ষা করছি। সেই ভদ্রলোক নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় পড়ি, কী পড়ি। বললাম। অল্প চুপ করে থেকে বললেন, ‘‘আপনারা তো আর বাংলা পড়েন না!’’ বয়সে অনেক ছোটদেরও এমন ‘আপনি’ করে সম্বোধনের সুনীতিকুমার-সুকুমার সেন ঘরানার রেওয়াজটি জানতাম। তাই অবাক হইনি। ঘোরতর প্রতিবাদ করে বলে উঠলাম, পড়ি তো! তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, বেশ! পাড় আর পার-এর মধ্যে পার্থক্য কী? বললাম, পাড় হল নদীর গা ছোঁয়া মাটি। আর নদীর পার সেই মাটিকে ছাপিয়ে অনেক দূর অবধি চলে যায়। মন্দির থেকে গোরস্থান, চাষের খেত থেকে হাট। আপনি ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ পড়েছেন? যেখানে লেখক বলছেন, তিস্তা আসলে একটি জনপদ!
তত ক্ষণে কবি এসে গিয়েছেন। আমার সব কথা সম্ভবত শুনেছেন। স্বভাবসিদ্ধ শান্ত স্বরে বললেন, ‘‘তোমার সামনে যিনি বসে রয়েছেন, তিনিই দেবেশ রায়।’’
এর পরে ‘আপনি’ আপনাআপনি ‘তুমি’ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় লেখার সুযোগ করে দিয়ে টিউশন করার ঝক্কি থেকে বাঁচিয়েছিলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই, তাঁরই সদ্য প্রকাশিত সময় অসময়ের বৃত্তান্ত উপন্যাসের গ্রন্থ সমালোচনা করার প্রস্তাব পেয়ে, অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম ফোন করে। উত্তরে শুনেছিলাম, ‘‘কী লিখবেন, তা সম্পূর্ণ আপনার সিদ্ধান্ত।’’ ঝলকে আবার ‘আপনি’-তে ফিরে যাওয়ায়, মনে হয়েছিল, অনুমতি দিচ্ছেন না। কিন্তু লিখেছিলাম। তাঁর কাছে সেটা নিয়ে যাওয়ার আগেই পড়ে ফেলেছিলেন। আর, আবার ‘তুমি’-তে ফিরেও গিয়েছিলেন। সে দিন অনেক কথা হয়েছিল। তার বহু বছর পরে বরিশালের যোগেন মণ্ডল প্রকাশিত হল। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ পড়ার মতোই সে-ও এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। যেন এক নতুন দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করলাম। এ বার জিজ্ঞাসা করলেন, উপন্যাসটি নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে হচ্ছে কি না! আমার খুবই তৎপরতার সঙ্গে ঘাড় নাড়া দেখে হেসে ফেলেছিলেন। তার পরে বললেন, লিখে ফেলো, কোনও কিছু পড়ে লিখতে ইচ্ছে করলে, সেটাই মস্ত বড় কথা।
আরও পড়ুন: বাংলা সাহিত্যে বিকল্প আদর্শের সন্ধানী, বিরল ভাবুক দেবেশ রায়
এতটাই বড় ছিলেন, বহুরূপী-র একটি নাটকের নিজে থেকেই খুব প্রশংসা করে সমালোচনা লিখলেন। ধন্যবাদ জানাতে গিয়েছি। সে দিন কত কথা হয়েছিল। যেমন হত কলকাতার জওহরলাল নেহরু রোডে তাঁর পত্রিকার দফতরে। কখনও অনেক লোক থাকতেন। আবার মাঝে মধ্যে একটু ফাঁকা পেলে কথা বলতেন। মনে হত, আলোকোজ্জ্বল এক জ্ঞানভাণ্ডারের দ্বার খুলে দিচ্ছেন চোখের সামনে। ভেঙে যেত একের পর এক বার্লিন ওয়াল। যে দেশে আছি বলে মনে হত, সে দেশ নতুন দেশ হয়ে উঠত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy