চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ। ফাইল চিত্র।
কলেরা কিংবা ডায়েরিয়া রোগে ওআরএসের বহুল প্রয়োগের সূচনা যাঁর হাত ধরে, সেই বাঙালি চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ প্রয়াত হলেন। শনিবার রাতে। বাইপাসের ধারের একটি হাসপাতালে। বছর খানেক আগে পর্যন্ত চিকিৎসা সাধনা এবং বিভিন্ন পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষটির বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
বয়সজনিত অসুখেই ভুগছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে। গত বেশ কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন চিকিৎসক। তবে তাঁর অসুস্থতার খবর প্রকাশ্যে আসেনি। কলেরা-ডায়েরিয়ার মতো রোগের চিকিৎসায় যাঁর অবদানের সুফল আজও পেয়ে চলেছেন গোটা বিশ্বের রোগী, সেই কৃতী চিকিৎসকের পরিচয়ও জানতে পারেননি তাঁর রোগ সারানোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনেকেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বনগাঁ সীমান্তে কলেরায় আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষকে বাঁচানোর নেপথ্যে মূল ভূমিকা ছিল এই চিকিৎসকের। বস্তুত, তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিতেই স্যালাইন সূচের মাধ্যমে ধমনীতে প্রবেশ করানোর বদলে পানীয়ের সাহায্যে খাওয়ানো শুরু হয়। নুন-চিনি-বেকিং সোডার জল দিয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন দিলীপ, অথচ তখনও ওআরএসের প্রয়োগে স্বীকৃতিই দেয়নি বিশ্ব চিকিৎসার নিয়ামক সংস্থা। ঝুঁকি নিয়েই কাজ করেছিলেন চিকিৎসক। পরে তাঁর হাত ধরেই স্বীকৃতি পায় ওআরএস।
১৯৫৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পাশ করে সেখানেই শিশু বিভাগে ইনটার্নশিপ শুরু করেন দিলীপ। ১৯৬০-এ লন্ডনে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস চালু হতে প্রচুর ডাক্তারের চাহিদা তৈরি হয়। দিলীপ আবেদন করতেই সুযোগ পান। এর পর লন্ডনে ডিসিএইচ করেন। এডিনবরা থেকে এমআরসিপিও। তার পর কুইন এলিজ়াবেথ হসপিটাল ফর চিল্ড্রেন-এ রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন এই বাঙালি চিকিৎসক। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৮। ওই পদেও তিনিই প্রথম ভারতীয়।
এর পর আমেরিকায় জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির মেডিকেল কেয়ার ফেলো পদে যোগ দেন দিলীপ। তখন ওই প্রতিষ্ঠানের একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে। কলেরা আক্রান্তদের চিকিৎসা হত সেখানে। ১৯৬৪-তে দেশে ফিরে দিলীপ সেখানে যোগ দেন। শুরু করেন ওআরএস এবং স্পেশাল মেটাবলিক স্টাডি নিয়ে গবেষণার কাজ। হাতেকলমে সাফল্য পেলেও গবেষণাপত্র বার করা হয়ে ওঠেনি। তার পরেই ঘটে ১৯৭১ সালের ওই ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধের পর শিকড় ছিঁড়ে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন এ পার বাংলার অস্থায়ী শিবিরে। সেই সব শিবিরে হঠাৎ মড়ক লাগে কলেরার। ক্রমশ তা মহামারির আকার নেয়। কয়েক জনকে সঙ্গী করে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন দিলীপ। শুরু হয়েছিল চিকিৎসা। দু’মাস অক্লান্ত কাজ করার পর সাফল্য আসে। সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেন আক্রান্তরা।
এর পরই বিশদ তথ্য দিয়ে ওআরএসের প্রয়োগ নিয়ে পেপার লেখেন। ১৯৭৩-এ জন হপকিনস মেডিক্যাল জার্নালে তা প্রকাশিত হয়। পরে ‘ল্যানসেট’ পত্রিকাও স্বীকৃতি দেয় ওই গবেষণালব্ধ পর্যবেক্ষণকে। কলেরা কিংবা ডায়েরিয়া রোগে আর আইভি-র (ইন্ট্রাভেনাস) পরিবর্ত হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পায় ওআরএস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ সসম্মানে ডেকে নেয় তাঁকে।
১৯৮০-র মধ্যপর্ব থেকে ১৯৯০-এর প্রথম পর্ব পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডায়রিয়া ডিজ়িজ় কন্ট্রোল প্রোগ্রাম-এর মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন তিনি। ১৯৯০-এ বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়ারিয়াল ডিজ়িজ় রিসার্চ-এর ক্লিনিক্যাল সায়েন্সের ডিরেক্টর হন। পরে ১৯৯৪-এ রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর সদস্য নির্বাচিত হন। পার্ক সার্কাসে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এও যুক্ত ছিলেন।
জন্মেছিলেন অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে। দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন— প্রথমে বরাহনগর, পরে শ্রীরামপুর। কাজের জন্য অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন। ১৯৯১ সালে সল্টলেকে নিজের বাড়িতে ‘সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজ়’ও তৈরি করেন। ডাক্তারি পাশ করা ছেলেমেয়েদের হাতেকলমে গবেষণা এবং ফিল্ডওয়ার্ক শেখানোর উদ্যোগ। ঠিক যে ভাবে তিনি চিকিৎসক হিসাবে তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন, সে ভাবেই ডাক্তারির ছাত্র-ছাত্রীদের শেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সেই শিক্ষা নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থী পাননি। তাঁর আফসোস ছিল, এ ব্যাপারে সরকারি সাহায্যও পাননি। প্রচারবিমুখ মানুষটি নিজের কাজের কথা জানাতে পারেননি। বাংলার এই কৃতী চিকিৎসকের জীবনাবসানও হল প্রচারের আড়ালেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy