রাস্তার এপার থেকে ওপারে ছুটছে গুলি। মুহুর্মুহু পড়ছে বোমা। সহকর্মীরা গাড়ি থেকে নামতে নিষেধ করলেও শোনেননি অমিত। বলেছিলেন, “এদের থামাতে না পারলে লোকজন মারা পড়বে।” এটুকু বলে কয়েক পা এগোতেই বোমা এসে পড়ে বীরভূমের দুবরাজপুর থানার সাব-ইনস্পেক্টর অমিত চক্রবর্তীর গায়ে। প্রাণহানি রুখতে যে সংঘর্ষ থামাতে গিয়েছিলেন, তাতে প্রাণ গিয়েছে শুধু তাঁরই।
বছর বত্রিশের অমিত ২০১৪-র জানুয়ারি থেকে ‘টাউনবাবু’ হিসেবে রয়েছেন দুবরাজপুর থানায়। ২০০৮-এর ব্যাচের এই সাব-ইনস্পেক্টর চলতি বছরের ৩ জুন গিয়েছিলেন যশপুর পঞ্চায়েতের গোপালপুর গ্রামে। ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে পুকুর সংস্কারকে ঘিরে তৃণমূল ও সিপিএমের সংঘর্ষ থামাতে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, যশপুর পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল। কিন্তু গোপালপুর গ্রামে সিপিএমের জোর বেশি। গোপালপুরের একটি পুকুরে ১০০ দিনের কাজে মাটি কাটা নিয়ে দু’পক্ষে ঝামেলা বাধে। গ্রামের বাসিন্দা কিছু সিপিএম সমর্থকের দাবি ছিল, ১০০ দিনের প্রকল্পে আগে কাজ করেও তাঁরা পঞ্চায়েত থেকে টাকা পাননি। তাঁদের বকেয়া মেটানোর পরে ওই গ্রামে ১০০ দিনের কাজ করুক পঞ্চায়েত। কিন্তু যশপুর পঞ্চায়েত টাকা না মিটিয়ে নতুন করে মাটি কাটাতে শুরু করে। পুকুরের মালিক কয়েকজন সিপিএম সমর্থক বিডিও-কে বিষয়টি জানালে বন্ধ হয় মাটি কাটার কাজ। সিপিএমের দাবি, তাতেই চটে গিয়ে গোপালপুরে হামলা করে তৃণমূল। পক্ষান্তরে তৃণমূলের অভিযোগ, বিনা প্ররোচনায় সিপিএমের লোকেরা তাদের কয়েকজনকে মারধর করাতেই ঝামেলা বাধে।
খবর পেয়ে দুবরাজপুর থানা থেকে পুলিশের যে বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছয়, ‘টাউনবাবু’ তাতে ছিলেন না। তাঁর সহকর্মী সাব-ইনস্পেক্টর রঞ্জিত বাউড়ি এবং এএসআই আদিত্য মণ্ডলেরা এলাকায় গিয়ে বোঝেন, ‘হাওয়া খারাপ’। আরও বাহিনী চেয়ে থানায় ফোন করেন রঞ্জিতবাবুরা। তৎকালীন ওসি ত্রিদিব প্রামাণিকের নির্দেশে কয়েক জন কনস্টেবলকে নিয়ে গোপালপুরের দিকে রওনা হন অমিত। রাত পৌনে ৯টা নাগাদ তিনি যখন গোপালপুরে পৌঁছন, ততক্ষণে বোমা-গুলি চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশকর্মীদের দাবি, রাতে পানাগড়-দুবরাজপুর ১৪ নম্বর রাজ্য সড়কের দু’পাশের দু’টি গ্রামে জড়ো হয় যুযুধানেরা। গোপালপুরের দিকে সিপিএম। রাস্তার উল্টো দিকে আউলিয়া গ্রামের প্রান্তে শাসক পক্ষের লোকজন। রাস্তার বাঁ দিকে (গোপালপুরের প্রান্তে) আউলিয়া-গোপালপুর স্কুলের গা ঘেঁষে গাড়ি থেকে নামেন অমিত। সাব-ইনস্পেক্টর রঞ্জিত বাউড়ির স্মৃতিচারণ, “বললেন, ‘এদের থামাতে না পারলে লোকজন মারা পড়বে’। কত বার বললাম, ‘পিছিয়ে আসুন’। শোনেননি।”
সহকর্মীরা জানান, অমিত আস্তে-আস্তে সামনে এগোচ্ছিলেন। সামান্য পিছনেই ছিল বাহিনী। কয়েক পা এগোতেই তাঁর গায়ে বোমা এসে লাগে। আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়েন ‘টাউনবাবু’। ধোঁয়ায় চারদিক ঢেকে যায়। ধোঁয়া কাটতে সহকর্মীরা ছুটে গিয়ে দেখেন, অমিতের বাঁ পাঁজরের নীচ থেকে পেটের অনেকটা অংশ উধাও! অন্ত্র বেরিয়ে এসেছে। রক্ত গড়িয়ে জায়গাটা একটা ছোটখাটো পুকুরের চেহারা নিয়েছে।
ঘটনাস্থলে হাজির পুলিশকর্মীরা জানান, দুবরাজপুরের একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে অমিতকে যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছে, তখন বার দু’য়েক তিনি বলেছিলেন, “বাবা-মা আমাকে বাঁচাও!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy