পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য। কিন্তু তাতেও শূন্যের ঘড়া পরিপূর্ণ হয়নি। ঘটনাচক্রে, তা হবে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে। আরও এক বার বাংলা থেকে রাজ্যসভায় শূন্য হয়ে যাবে সিপিএম। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগেই রাজ্যসভার পাঁচটি আসনের ভোট। মেয়াদ শেষ হবে তৃণমূলের সুব্রত বক্সী, মৌসম বেনজির নূর, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সাকেত গোখলের। একই সময়ে মেয়াদ শেষ হবে সিপিএমের আইনজীবী-নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যেরও। কিন্তু বিধানসভায় শূন্য হয়ে যাওয়ায় সিপিএম বাংলা থেকে বিকাশরঞ্জন বা অন্য কাউকে আর রাজ্যসভায় পাঠাতে পারবে না। সেই আসনে আরও এক জনকে রাজ্যসভার সাংসদ করতে পারবে রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপি।
২০১১ সালে রাজ্যে ‘পরিবর্তনের নির্বাচনে’ বিধানসভায় ৬২টি আসন জিতেছিল সিপিএম-সহ বামফ্রন্ট। সেই ধাক্কায় বাংলা থেকে সিপিএমের রাজ্যসভার আসন কমতে শুরু করে। ২০১১ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা থেকে সিপিএমের হয়ে দ্বিতীয় বারের জন্য রাজ্যসভা সাংসদ হন অধুনাপ্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরি। ২০১২ সালেও মাত্র এক জনকেই বাংলা থেকে রাজ্যসভায় পাঠানোর সুযোগ ছিল সিপিএমের কাছে। সেবার সিটু নেতা তপন সেনকে দ্বিতীয় বার রাজ্যসভায় মনোনয়ন দেয় সিপিএম। ২০১৪ সালে খানিকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই নবীন প্রজন্মের নেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যসভায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সিপিএম। কিন্তু ২০১৭ সালে ‘নীতিগত বিচ্যুতি’-সহ একগুচ্ছ অভিযোগে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে সিপিএম। তার পরের মেয়াদে ঋতব্রত রাজ্যসভায় ‘দলহীন সাংসদ’ হিসেবাই ছিলেন। ২০১৮ সালে সিটু নেতা তপনের রাজ্যসভার আসনের মেয়াদ শেষ হলে বাংলা থেকে রাজ্যসভায় শূন্য হয়ে যায় সিপিএম।
২০২০ সালে সিপিএমের সঙ্গে জোট আরও ‘মজবুত’ করতে তৎকালীন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান এআইসিসির কাছে দরবার করেন সিপিএমকে রাজ্যসভার আসনটি ছেড়ে দিতে। বস্তুত মান্নানই সিপিএমকে অনুরোধ করেছিলেন রাজ্যসভার ওই আসনে বিকাশকে মনোনয়ন দিতে। কারণ, সুপ্রিম কোর্টে মান্নানের দায়ের-করা সারদা মামলার সুবাদে বিকাশের সঙ্গে মান্নানের ‘ঘনিষ্ঠতা’ ছিল। আইনজীবী বিকাশ প্রবীণ কংগ্রেসি নেতা মান্নানকে ব্যক্তিগত ভাবেও পছন্দ করতেন। সেই সুবাদে কংগ্রেস পরিষদীয় দল সমর্থন করেছিল সিপিএমের বিকাশকে। কারণ, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বামেরা ৩২টি আসনে জিতেছিল। ফলে একক ক্ষমতায় তাদের পক্ষে রাজ্যসভার আসন জেতা সম্ভব ছিল না। ফলে কংগ্রেস-বামফ্রন্টের যৌথ সমর্থনে রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছিলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন। কিন্তু তিনি আগামী বছর ফেব্রুয়ারির পরে আর রাজ্যসভায় ফিরতে পারবেন না।
মূলত যাঁর উদ্যোগে বিকাশ রাজ্যসভায় গিয়েছিলেন, সেই মান্নান বলেন, ‘‘এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেস বা বামেদের কোনও প্রতিনিধি রাজ্যসভায় থাকবেন না। ২০১৬ সালে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট আসন সমঝোতা হয়েছিল। সেই সমঝোতা রাজ্যের মানুষের একাংশের সমর্থনও পেয়েছিল। পরে আমি বিরোধী দলনেতা হিসেবে বামেদের সঙ্গে জোট গড়েই এগিয়েছিলাম। কিন্তু দু’দলের কিছু সুবিধাবাদী নেতা নিজেদের মতো করে জোট গড়েন। পরে তাঁরাই আবার জোট ভাঙেন। এর ফলে সাধারণ মানুষের কাছে কংগ্রেস, বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সেই সুযোগে বিজেপি উঠে আসে। বাম-কংগ্রেস শূন্য হয়ে যায়।’’ বিকাশ অবশ্য রাজ্যসভার শূন্যগর্ভতায় ‘অস্বাভাবিক’ কিছু দেখছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘এর মধ্যে কোনও অস্বাভাবিক কিছু নেই। সংসদীয় রাজনীতিতে এমন হয়। হতেই পারে। এক সময়ে বাংলা থেকে লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে বামেদের ৬০ জনেরও বেশি সাংসদ ছিলেন। বামেরা এখন ভোটে জিততে না পারায় সেই সংখ্যা কমতে কমতে শূন্য হয়ে গিয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, সংসদীয় রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই সিপিএম বা বামপন্থীরা এই রাজ্য থেকে আবার সাংসদ পাবেন।’’
ঘটনাপরম্পরা বলছে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রথম বাংলায় শূন্য হয়েছিল সিপিএম। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও সেই ধারা বজায় থেকেছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের আসন ছিল শূন্য। ২০১৮ সালের শ্রমিকনেতা তপনের রাজ্যসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার সময়েও রাজ্যসভায় বাংলা থেকে কোনও সাংসদ ছিলেন না সিপিএমের। তবে ২০১৭ সালে যখন কংগ্রেস তাদের সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যকে দ্বিতীয় বারের জন্য রাজ্যসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রার্থী করে, তখন পাঁচ আসনের লড়াইয়ে ‘ষষ্ঠ প্রার্থী’ হিসাবে আইনজীবী বিকাশকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আলিমুদ্দিন ষ্ট্রিট। সে বার নাটকীয় ভাবে মনোনয়ন দাখিল করার সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে বিকাশ মনোনয়ন জমা দিতে যান। ফলে তাঁর প্রার্থিপদ গ্রহণ করেনি নির্বাচন কমিশন। যদিও অনেকে বলেছিলেন, বাংলায় ‘জোটসঙ্গী’ কংগ্রেসের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই এড়াতেই ওই ‘কৌশলী পদক্ষেপ’ করেছিল সিপিএম।
২০১৮ সালে তৃণমূলের চার প্রার্থীর সঙ্গে বাংলা থেকে এআইসিসি নেতা অভিষেক মনু সিংভিকে মনোনয়ন দিয়েছিল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। সেবার রবীন দেবকে ষষ্ঠ আসনে প্রার্থী করেছিল সিপিএম। জিতেছিলেন তৃণমূলের চার জন এবং কংগ্রেসের অভিষেক। পরাজিত হন রবীন। পরে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়েই বাংলা থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে বিকাশকে পেয়েছিল সিপিএম। কিন্তু সেই আসনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছর ২ এপ্রিল। ঠিক সময়ে ভোট হলে তখনও বিধানসভা নির্বাচন শেষ হবে না। অর্থাৎ, বিধানসভা ভোটের আগে বিধানসভা এবং লোকসভার মতো রাজ্যসভাতেও শূন্য হয়ে যাবে সিপিএম।
তিন দফায় পশ্চিমবঙ্গের ১৬টি রাজ্যসভা আসনে ভোট হয়। একটি দফায় ছ’টি আসনে রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচনে ৪২ জন বিধায়কের সমর্থন প্রয়োজন হয়। বাকি দু’বার পাঁচ জন করে সাংসদ নির্বাচিত হন। সে ক্ষেত্রে ৫০ জন বিধায়কের সমর্থন প্রয়োজন হয়। এখন সিপিএমের হাতে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কোনও বিধায়কই নেই। বিজেপি হয়ে গিয়েছে প্রধান বিরোধী দল। যার সুবাদে ইতিমধ্যে অনন্ত মহারাজ এবং শমীক ভট্টাচার্যকে রাজ্যসভায় পাঠাতে পেরেছে তারা। আগামী বছর বিকাশের মেয়াদ উত্তীর্ণ আসনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও এক জনকে রাজ্যসভার সাংসদ করতে পারবে বিজেপি।