Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
চারপেয়ের চালান-যাত্রা ৩

শেষ রাতে ফোনে সঙ্কেত, পার সীমান্ত-বৈতরণী

সীমান্তের অর্থনীতি নাকি চার পায়ে হাঁটে। পাচারের গরুর ক্ষুরে ক্ষুরে টাকা ওড়ে, যার দাপটে গুলিয়ে যায় আইন আর নজরদারির সব হিসেব-নিকেশ। দেখে এল আনন্দবাজার।ট্রাক-যাত্রা শেষ। এ বার পায়ে হাঁটা। চারপেয়েদের খেদিয়ে নিয়ে চলেছে দু’পেয়েরা। কিছুটা গিয়ে বিলপাড়ে বিরতি। সামনে আংড়াইল সীমান্ত। রাখাল জানাল, আগে অনেকটা হাঁটতে হতো। গরুর পায়ে পায়ে খেতের ফসল, ঘর-দোর নষ্ট হতো। সে বিস্তর ঝামেলা। তাই এখন বর্ডারের কাছে মাল খালাস হচ্ছে। আপাতত অপেক্ষা, কখন ‘লাইন ক্লিয়ার’ হবে। মানে, দেড়-দু’ঘণ্টার জন্য সীমান্ত থেকে নজরদারি উঠে যাবে। রক্ষীরা দেখেও কিছু দেখবে না। আয়াসে ও-পারে ঢুকে পড়বে গরুর পাল।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

ট্রাক-যাত্রা শেষ। এ বার পায়ে হাঁটা। চারপেয়েদের খেদিয়ে নিয়ে চলেছে দু’পেয়েরা।

কিছুটা গিয়ে বিলপাড়ে বিরতি। সামনে আংড়াইল সীমান্ত। রাখাল জানাল, আগে অনেকটা হাঁটতে হতো। গরুর পায়ে পায়ে খেতের ফসল, ঘর-দোর নষ্ট হতো। সে বিস্তর ঝামেলা। তাই এখন বর্ডারের কাছে মাল খালাস হচ্ছে। আপাতত অপেক্ষা, কখন ‘লাইন ক্লিয়ার’ হবে।

মানে, দেড়-দু’ঘণ্টার জন্য সীমান্ত থেকে নজরদারি উঠে যাবে। রক্ষীরা দেখেও কিছু দেখবে না। আয়াসে ও-পারে ঢুকে পড়বে গরুর পাল।

গোটাটাই অনিয়ম। সীমান্ত দিয়ে গবাদি পশু রফতানি আইনত নিষিদ্ধ। জীবন্ত গবাদি পশুকে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যেতেও বিশেষ অনুমতি লাগে। দুই নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় নিত্য চলছে এই কাণ্ড।

পেট্রাপোল শুল্ক দফতরের সহকারী কমিশনার শ্রীরাম বিষ্ণুইয়ের কথায়, ‘‘গবাদি পশু রফতানির নিয়ম নেই। বাংলাদেশে যা গরু যায়, সব চোরাপথে।’’

এবং পাচারের কাঁচা (বা কালো) টাকার লোভে হাজার-হাজার মানুষ চক্রে জড়াচ্ছে। চক্র সচল রাখতে দরকার হয়ে পড়ছে আরও, আরও গরু। চাহিদা সামাল দিতে পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানে রীতিমতো গরু চাষ হচ্ছে। হাইব্রিড করে পাল-কে-পাল ফলানো হচ্ছে ছ’ফুট উঁচু বিশালাকৃতি ‘আন্ডু।’ হাত-ফেরতা হয়ে তারা চলে আসছে পশ্চিমবঙ্গে, সীমান্ত অতিক্রমের জন্য।

পঞ্জাবের রসুলপুর গরুহাটের এমনই এক ব্যাপারি সুলেমান। হিসেব দিলেন, ‘‘পঞ্জাব থেকে পান্ডুয়া দু’হাজার কিলোমিটার ট্রাকভাড়া দেড় লাখ। কন্টেনার নিলে পঁচিশ হাজার বেশি। সব খরচ-খরচা বাদেও ট্রাক-মালিকের ফি ট্রিপে পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ থাকে।” শুনে বারাসতের এক ট্রাক-মালিকের মন্তব্য, ‘‘রসুলপুর থেকে দশচাকা ট্রাকে সাধারণ মালপত্র আনতে ভাড়া ১ লাখ ৮ হাজারের মতো। এক পিঠেই আধ লাখ বাড়তি পেলে কে ছাড়বে?” মালিকদের এ-ও পর্যবেক্ষণ, ট্রাকে বৈধ মাল তুললে পুলিশ বেশি ঝামেলা করে। গরু তুললে সব ছাড়। শুধু খাই মেটালেই হল।’’


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

তবে সেই ‘খাই’ মেটানোর প্রক্রিয়ার পরতে-পরতে ‘শৃঙ্খলা’র বেড়ি বাঁধা থাকায় ব্যাপারিরা নিশ্চিন্ত। যেমন, পান্ডুয়া হাটে ২২ হাজার টাকা দরে চব্বিশটা গরু কিনতে প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা লাগলেও হাটের চালানে লেখা হল মাত্র ১ লাখ ৪০ হাজার।

সেই ‘চাপা’ দামেরই হিসেবে পান্ডুয়া রেগুলেটেড মার্কেটিং কমিটি-র নামে আড়াই হাজারের রসিদ কাটা হল। ফাঁকি পড়ল রাজ্যের প্রাপ্য লেভি’তে। পার্কিংয়ে তিনশো গেল, হাটে তৃণমূল ইউনিয়ন অফিসকে দু’শো। লেভি ফাঁকি দিয়ে যা বাঁচল, তার তুলনায় নগণ্য বললেই চলে। শোনা গেল, ইদানীং বাংলাদেশি পাচারকারীরা অনেকে পেমেন্ট করছে সোনায়। তাতে হোক না হোক, পাঁচ হাজার টাকা মুনাফা বাড়ছে। সোনায় সোহাগা!

আমার ট্রাকের মালিক প্রথমেই জানিয়ে রেখেছিলেন, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া বা উত্তর ২৪ পরগনা সীমান্তে যখন যে ‘লাইন’ খোলা থাকে, সেখান দিয়ে গরু ঢোকানো হয়। কলকাতার কাছে পড়ে বনগাঁ, বসিরহাট। দীর্ঘ দিন এই রুটে চালু থাকা পাচার ‘সেট আপ’ নাকি দুর্দান্ত।

গোটা কারবারটা চলে মুখের কথা আর পারস্পরিক ‘সততা’র ভরসায়। পরিক্রমা সেরে এর সত্যতা মালুম হল। ওস্তাদ বললেন, ‘‘মাঝে মধ্যে উটকো ঝামেলায় রুট বদলাতে হয়। যেমন বারাসত-মধ্যমগ্রামে পুলিশ হঠাৎ কড়াকড়ি শুরু করলে সোদপুর-ব্যারাকপুর ধরতে হয়।” তবে সে-ও সাময়িক। “আমদানিতে টান পড়লে থানাই ফোনাফুনি করে ফের ডেকে আনে।’’ সহাস্যে জানালেন ওস্তাদ।

টুকরো কথা-বার্তায় রাত গড়াতে থাকে। অপেক্ষার পালা শেষ হল যখন, ঘড়িতে সাড়ে তিনটে। মোবাইলে বার্তা এল লাইন ওপেন। মানে কিনা, সীমান্তরক্ষীরা চোখে ঠুলি আঁটলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ডুমা বাঁওড়ে নামিয়ে দেওয়া হল গরুর দলকে। গলা জলে তারা কখনও হাঁটছে, কখনও সাঁতরাচ্ছে। বাঁওড় টপকালেই ইছামতীর ঘোলা স্রোত। নদীর এ-পার থেকে জোরালো টর্চের আলো ছুটল ও-পারে। লেসার টর্চের তীক্ষ্ন আলোকরেখায় পাল্টা সঙ্কেত ‘ডেলিভারি’ পার্টি তৈরি।

মুহূর্তে প্রবল হুড়োহুড়ি। সার সার গরু এ বার নদীপথে। পাঁচ-ছটি’র গলায় বাঁধা দড়ি হাতে এক জন করে লাইনম্যান। আর এক জন প্রাণিগুলির পিছনে বাড়ি কষিয়ে হেট-হেট শব্দে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রামচন্দ্রপুরের সিরাজুল হল গিয়ে লাইনম্যান। বলল, “আগে ও-দিকের লোক এসে মাল নিয়ে যেত। এখন আমরা নিয়ে যাই। এক বার পার করলে আড়াইশো টাকা।’’ আংড়াইল বর্ডারে ওর মতো শ’দুয়েক ছেলে নাকি এই করেই পেট চালায়।

প্রচণ্ড আওয়াজ তুলে ইছামতী সাঁতরে গরুর পাল ততক্ষণে ছুঁয়ে ফেলছে বাংলাদেশের মাটি। যশোহরের পুঁটখালি। পিঠে আঁকা মনোহরের সিলমোহর টর্চের আলোয় যাচাই করে নিজেদের জিনিস বুঝে নিচ্ছে ও-পারের কারবারিরা। পথের ক্লান্তি, অত্যাচার, শীতের হাড়-হিম জল সব মিলিয়ে চালানির চারপেয়েরা ইতিমধ্যে অধর্মৃত।

তার উপরে মুহুর্মুহু ছড়ির বাড়ি। মানুষের এ হেন অমানবিকতা দেখে মনুষ্যেতরদের বড় বড় চোখগুলো আরও বিস্ফারিত হয়ে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে!

দেখছি, ওরা পা মুড়িয়ে নেতিয়ে পড়ে যাচ্ছে। পরক্ষণে সপাং-সপাং শব্দ। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। দৌড়চ্ছে। নতুন দেশে নতুন মালিকেরা হাত বাড়িয়ে আছে।

আর দেখতে পারলাম না।

চোখ ফেরালাম। সিরাজুল বলল, “চলো, চলো, আজকের কাজ খতম। আবার কাল।”

(শেষ)

অন্য বিষয়গুলি:

cow trafficking arunakhsya bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE