প্রতীকী ছবি।
আমার নিকটতম প্রতিবেশীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। সে দিন আমি তাঁকে কোলে করে দোতলা থেকে নামিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলেছিলাম। আর গত কাল ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে বিকেলবেলা একটু হাঁটতে গিয়ে দেখা হতেই ছিটকে সরে গেলাম। যত ক্ষণ পায়চারি চলল, দু’জনেই যতটা সম্ভব দূরত্ব রচনার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
মানুষ আজ মানুষের নিঃশ্বাস থেকে পালাতে চাইছে। পালানোই উচিত। ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ দরকার এখন, যতটা সম্ভব। যে বা যাঁরা ‘অলক্ষুণে অসুখ’ নিয়ে লুকিয়ে থাকছেন বা ভিড়ে মিশছেন, তাঁরা নিজেদের আত্মীয়-পরিজন-বন্ধুদেরই সব চেয়ে বেশি বিপদে ফেলছেন। এই সহজ সত্যটুকু অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগে সবাই বুঝলে পরে মঙ্গল।
একটা-দুটো করে তারা ফুটে উঠতে থাকে, আর সে দিকে তাকিয়ে মণিকাকুর কথা মনে পড়ে, পৃথিবী যাঁকে চিনত গৌতম চট্টোপাধ্যায় নামে। ছোটবেলায় ওঁর পরিচালনায় পাড়ার নাটকে অভিনয় করেছি। আর তখনই কে যেন বলেছিল, এক-একটা তারা দেখা মানেই লক্ষ লক্ষ বছর পিছনে তাকানো। আচ্ছা, পিছনে না হয়ে তারাগুলো তো সামনেও থাকতে পারে? প্রশ্নটা করার আগেই মণিকাকু আলোকবর্ষ দূরে চলে গেলেন।
মাটির পৃথিবীতে রং নিয়ে মারামারি থাকলেও সূর্যাস্তের সময়ে আকাশে অনেক রঙের সহাবস্থান। সেই রংগুলোকেই এখন এক-একটা মহাকাব্যের মতো মনে হয়; রামায়ণ-মহাভারত থেকে ইলিয়াড-ওডিসি, সর্বত্রই তো ছড়িয়ে আছে ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’। চোখ থেকে চশমা খুলে নিলেই থ্রি-ডি সিনেমা যেমন টু-ডি হয়ে যায়, ভূগোল ও সময়ের মাত্রাটা সরিয়ে নিলেই হয়তো দেখা যাবে, লক্ষ্মণ আর অর্জুনের দেখা হয়ে যাচ্ছে বনের পথে এবং উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসছেন ইউলিসিস। কিন্তু কোন ইথাকা, কোন মালগুডি, কোন মাহিষ্মতী ফুলের মালা হাতে অপেক্ষা করে আছে ওঁদের জন্য?
আমার এক দূর সম্পর্কের মামার ছেলে ফোনে কাঁদছিল। অনেক পরিশ্রম করে মিউরিয়েট অব পটাশের সঙ্গে কাঠকয়লার গুঁড়ো ও নিমের খোল মিশিয়ে এক বিঘে জমিতে ও চন্দ্রমল্লিকা ফুটিয়েছে। কিন্তু এই যে অসুখ এসেছে, মৃতদেহেরও ফুল নয়, প্লাস্টিক লাগে শুধু!
ফুল বিক্রি না হলে ফুলচাষি মরে, শিল্প বিক্রি না হলে শিল্পীও বাঁচবে না। কিন্তু আগামী দিনগুলোয় বই-গান-সিনেমার জন্য কতটুকু অক্সিজেন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে? সারা পৃথিবীর অর্থনীতিই যে ভেন্টিলেটরে চলে গেল।
‘গেল গেল’ রব তুলতে রাজি নই তাও। বিশ্বপ্রকৃতি কোনও ইঞ্জিনিয়ার নয় যে, বাড়ি ভেঙে পড়লেই প্ল্যানে ভুল ছিল বলে চেঁচানো যাবে। বিশ্বপ্রকৃতি সেই পাখি, যা ছাদের কোটরে বট-অশ্বত্থের বীজ এনে জমা করে। সেই বীজ ধ্বংস আর সৃষ্টির কথা একসঙ্গেই বলে। আজও তাই মানুষের স্বাধীনতা কমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হরিণের স্বাধীনতা, কচ্ছপের স্বাধীনতা।
মানুষও পেরিয়ে আসবে এই ক্রান্তিকাল। অনন্ত ধ্বংসের ভিতরেও শিল্পকে সঙ্গে নিয়েই পেরোবে, কারণ আলতামিরার গুহায় সে মুখ এঁকেছিল কারও, জমা-খরচের হিসেব লেখেনি। আর এই যে দাঁড়িপাল্লার মাল-ঠাসা দিকটার অন্তঃসারশূন্যতা দেখে যাচ্ছি, আমাদের মধ্যে যারা থাকব, তারা নিশ্চয়ই ‘গন্ধ-রসের বিপুল আয়োজন’কে প্রত্যাখ্যান করতে পারব ভবিষ্যতে।
আপাতত সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চাই। সময় যদি বলে, ‘‘যেতে নাহি দিব’’, আমিও বলব, “নেভার লেট মি গো।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy