রাজ্যের ৩ কোটিরও বেশি বাসিন্দাদের মধ্যে ত্রিস্তর বিশিষ্ট উচ্চমানের মাস্ক বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। —ফাইল চিত্র।
আমাদের পৃথিবীতে সাধারণত দু’ধরনের মানুষ দেখা যায়। এক ধরনের মানুষ যারা মুখে বড় বড় কথা বলেন, আরেক ধরনের মানুষ যাঁরা কাজ করেন।
গত মার্চ মাস থেকে এখনও পর্যন্ত এটা বোঝা যাচ্ছে, যে রাজনৈতিক দল নিজেদের পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বলে পরিচয় দেয়, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত, তারাই কিন্তু সবচেয়ে বড় বড় কথা বলা রাজনৈতিক দল।
অন্যদিকে একজন মানুষ, যিনি সারাজীবন মানুষের সঙ্গে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে চলেছেন, তিনি আজ এমন একটি রাজ্যকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যার জনসংখ্যা জার্মানি, ইতালি বা ফ্রান্সের মতো দেশের জনসংখ্যার থেকে বেশি।
আরও পড়ুন: বিজেপি-র ঘরে কি ‘মুখ্যমন্ত্রী’ কম পড়িয়াছে
এবার আসি ১৯-টি ভিন্ন ভিন্ন সূচকে বাংলা কেন কোভিড-১৯ সংক্রমণ আটকানোয় অন্যদের থেকে এগিয়ে, সেই প্রসঙ্গে।
১) আগে থেকে কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ড নির্মাণ: ১৭ মার্চ বাংলায় প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার কেসটি রিপোর্টেড হয়। তার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতার সম্ভাব্য করোনা-আক্রান্তদের কথা ভেবে আইসোলেশোন ওয়ার্ড তৈরি রেখেছিল। এমনকি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক শাখায় একটি ক্যাম্প প্রস্তুত করে, যাতে থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের অব্যবহিত পরেই ‘সন্দেহভাজন’ কোভিড আক্রান্ত যাত্রীদের দ্রুত কোয়রান্টিনে পাঠানো যায়। যত দ্রুত সম্ভব বাংলায় ৫৮২টি কোয়রান্টিন সেন্টারও গড়ে তোলা হয়।
২) যত দ্রুত সম্ভব সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু কোভিড-১৯কে অতিমারি হিসেবে ঘোষণা করার আগেই, যে কয়েকজন হাতে গোনা মুখ্যমন্ত্রী করোনাভাইরাস যে এক গণস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা আনতে চলেছে অনুমান করতে পেরেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একদিন আগেই তাঁর সংসদীয় দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির এক জরুরি সভা ডাকা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়। ১৬ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী ২০০ কোটি টাকার এক আপৎকালীন তহবিল গঠন করেন। বলাই বাহুল্য, বাংলাই প্রথম এমন পদক্ষেপ করে।
৩) বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের বার্তা দিলেন: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগাম বুঝতে পেরেছিলেন যে, লকডাউনের ফলে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। ২৬ মার্চ তিনি ১৮টি রজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আবেদন রাখেন। অন্য রাজ্য থেকে এ রাজ্যে আগত শ্রমিকদের আশ্রয় প্রদান ও দেখাশোনার প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন।
৪) সর্বাগ্রে লকডাউনের সিদ্ধান্ত: জাতীয় স্তরে লকডাউন ঘোষিত হওয়ার আগেই ২২ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা সহ রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় লকডাউনের নির্দেশ দেন । বাংলার এই লকডাউনের ঘোষণা মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে হয়নি। বাংলা দুগ্ধ ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রেখে মিষ্টির দোকান খোলা রাখার কথা বলা হয়। একই ভাবে মুর্শিদাবাদের বিড়ি শ্রমিকদের এবং ফুলের বাজারের কর্মীদের সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
৫) দরিদ্র মানুষের জন্য বিনামূল্যে রেশন: ২০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘোষণা করে, যাঁরা ভর্তুকি যুক্ত খাদ্যশস্য পান, তাঁরা বিনামূল্যে তা পাবেন। এই ত্রাণ প্যাকেজ রাজ্যের ৭.৫ কোটি মানুষকে প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করে। ৩০ জুন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, এই বিনামূল্যে রেশন পাওয়ার মেয়াদ ২০২১-এর জুন পর্যন্ত বাড়ানো হল।
৬) নাগরিকদের জন্য উচ্চ মানের মাস্ক বিতরণ: রাজ্যের ৩ কোটিরও বেশি বাসিন্দাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ত্রিস্তর বিশিষ্ট উচ্চমানের মাস্ক বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়, যা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারা প্রসংশিত হয়। ১২ এপ্রিলের মধ্যে মাস্ক পরাকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে রাজ্য সরকার।
অতিমারির ফলে জাত আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় মোকাবিলায় এক গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি কমিটি গঠন করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ইতিমধ্যে ১৩টি মিটিং করেছে এই কমিটি।—ফাইল চিত্র।
৭) গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি কমিটি: এপ্রিলের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার করোনাভাইরাস অতিমারির ফলে জাত আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য এক গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি কমিটি গঠন করে, যেখানে অগ্রণী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাখা হয়। এই কমিটি ইতিমধ্যে ১৩টি মিটিং করেছে।
৮) বাংলায় বিনামূল্যে চিকিৎসা: হাতে গোনা যে ক’টি রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করা হচ্ছে, বাংলা তাদের মধ্যে অন্যতম। এই চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ রাজ্য সরকার বহন করছে। এই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, কোভিড মহামারির আগে থেকেই পরীক্ষা, চিকিৎসা ও ওষুধ বাংলার সরকারি হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যেই দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রাইভেট হাসপাতালগুলিতে ‘স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের’ অধীনে বিনামূল্যে ৭.৫ কোটি মানুষকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যের চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
৯) ১০ লক্ষ টাকা অর্থমূল্যের বিমা কভারেজ: মার্চ মাসে বাংলার সরকার সেই সব মানুষের জন্য ১০ লক্ষ টাকার বিমা কভারেজ ঘোষণা করে, যাঁরা রাজ্যকে কোভিড-মুক্ত করার জন্য লড়াই করছেন। এর মধ্যে রয়েছেন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্মীরা—চিকিৎসক, সাফাইকর্মী, ফার্মাসিস্ট, নার্স, কুরিয়ার কর্মী, আশা কর্মী, সাংবাদিক, পুলিশ কর্মী এবং তাঁদের পরিবারের লোকজন।
১০) পেনশন: দু’মাসের সামাজিক সুরক্ষা পেনশন ও ভাতা অগ্রিম প্রদান করা হয়।
১১) পরীক্ষাগারের সংখ্যা ২৭ গুণ বাড়ানো হয়: মার্চের শেষ দিকে রাজ্যে কোভিড -১৯ পরীক্ষার জন্য মাত্র ২টি ল্যাবরেটরি ছিল। এখন এমন ল্যাবের সংখ্যা ৫৪। কেন্দ্র সকারের পাঠানো ত্রুটিযুক্ত কিট পাঠানো সত্ত্বেও মার্চের মধ্যে বাংলায় কোভিড পরীক্ষা ৪৪১ গুণ বেড়েছে। রাজ্যে এই মুহূর্তে প্রতিদিন ১৩,০০০ স্যাম্পলের পরীক্ষা হচ্ছে।
১২) কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয় হ্রাস: জুন মাসে মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড পরীক্ষার ব্যয় ২২৫০ টাকা, প্রতিদিনের পিপিই-র ব্যয় ১০০০ টাকা এবং চিকিৎসকের সাম্মানিক দৈনিক ১০০০ টাকা নির্ধারণ করে দেন।
১৩) সেফ হোম: রোগলক্ষণ রহিত অথবা মৃদু লক্ষণ যুক্ত কোভিড রোগীদের মধ্যে যাঁদের বাড়িতে থেকে চিকিৎসার তেমন সুবিধা নেই, তাঁদের জন্য বাংলার সরকার বিনামূল্যে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করেছে। কেন্দ্র সরকারও এই পদক্ষেপের প্রসংশা করেছে এবং অন্য রাজ্যকে এই বিষয়ে বেঙ্গল মডেল অনুসরণ করতে বলেছে।
আরও পড়ুন: গালওয়ানে বর্তমান অবস্থান বজায় থাকলে কিন্তু ফায়দা চিনেরই
আরও পড়ুন: চিন ও ভারত দুই রাষ্ট্রই বহন করছে সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহ্য
১৪) কর্মনিযুক্তির দিকে বিশেষ নজর: সেরে ওঠা রোগীদের তালিকা তৈরি করে বাংলার সরকার তাঁদের ‘কোভিড যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বাংলা জুড়ে হাসপাতালগুলিতে নন মেডিক্যাল কর্মী হিসেবে তাঁদের নিযুক্তির কথাও ভাবা হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী জেলা শাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁরা যেন পরিযায়ী শ্রমিকদের দক্ষতা ভিত্তিক তালিকা প্রস্তুত করেন, যাতে ভবিষ্যতে তাঁদের জীবিকার বন্দোবস্ত করা যায় এবং একই সঙ্গে রাজ্যের জন্যও একটি মজুদ কর্মী বাহিনী তৈরি রাখা যায়।
১৫) শ্রমিকদের জন্য আর্থিক সহায়তা: বাংলার সরকার ‘স্নেহের পরশ’ প্রকল্প দ্বারা লকডাউনে অন্য রাজ্যে আটকে পড়া প্রায় এক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে এককালীন ১০০০ টাকা অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করেছে।
‘প্রচেষ্টা প্রকল্প’ দ্বারা রাজ্য সরকার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের এককালীন ১০০০ টাকা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে।
কেন্দ্র সরকার যেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছ থেকে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনগুলিতে স্লিপার ক্লাসের পুরো ভাড়া নিচ্ছে এবং তার উপর অতিরিক্ত ৫০ টাকা নিচ্ছে, সেখানে বাংলার সরকার এ রাজ্যের শ্রমিকদের ভিন্ রাজ্য থেকে ফেরাতে ট্রেন ভাড়ার সম্পূর্ণটাই বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১৬) ২৪x৭ কোভিড-১৯ হেল্পলাইন: রাজ্য সরকার একটি ওয়ান স্টপ কোভিড-১৯ হেল্পলাইন চালু করেছে, যাতে একটাই মাত্র ফোন কল দ্বারা কোনও সন্দেহভাজন রোগী প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারেন। চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট থেকে পরীক্ষা, এমনকি দোরগোড়ায় অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত হাজির থাকতে পারে এই হেল্পলাইন মারফত।
১৭) গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত হেল্পলাইন: লকডাউন পর্বে মহিলাদের উপর গার্হস্থ্য হিংসা বেড়েছে। পশ্চিম বঙ্গের কমিশন ফর উইমেনস রাইটস এই সংক্রান্ত একটি হেল্পলাইন চালু করেছে। ৯৮৩০৯৪৭২৪৭ নম্বরে ডায়াল করে এই সংক্রান্ত অভিযোগ জানানো যাবে। এই অভিযোগ স্থানীয় থানায় ফরওয়ার্ড করা হবে।
১৮) বাড়ি বাড়ি মিড ডে মিল পৌঁছে দেওয়া: আইসিডিএস প্রোগ্রামের দ্বারা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের মাধ্যমে শিশুদের মিড ডে মিল বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯) কোভিড-১৯-এ মৃতদের স্বজনের জন্য চাকরির বন্দোবস্ত: ১৬ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয় যে, কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রয়াত রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের স্বজনদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে ।
*পুনশ্চ: এই ক’টা উপায় কি কোভিড সংক্রমণ আটকানোর জন্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায়? একেবারেই নয়, কারণ এই পরিস্থিতিতে আমরা রোজ নতুন করে শিখছি, জানছি। কিন্তু কিছু শিখতে চাইলে লাগে হৃদয়ের আবেগ ও বিনয়, যা বাংলার সরকারের আছে কিন্তু দিল্লিতে বসে থাকা সরকারের নেই।
লেখক রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের দলনেতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy