ফাইল চিত্র।
দেশ জুড়ে যার জন্য হাহাকার, সেই অক্সিজেন মজুত ছিল। কিন্তু তার সিলিন্ডারে লাগানোর যন্ত্র ‘ফ্লো-মিটার’ পর্যাপ্ত সংখ্যায় না-থাকার কারণে বেহালার বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে মঙ্গলবার সকালে দু’জনকে প্রাণ খোয়াতে হল বলে অভিযোগ মৃতের পরিবারের সদস্যদের। তাঁদের নাম মনোয়ারা বেগম (৬০) এবং যমুনা নাথ (৫০)। প্রথম জনের বাড়ি ঠাকুরপুকুরে, দ্বিতীয় জনের বেহালার রবীন্দ্রনগর। তবে মঙ্গলবার রাত্রি পর্যন্ত কোনও লিখিত অভিযোগ জমা পড়েনি।
অক্সিজেনের সিলিন্ডারে ফ্লো-মিটার হল, অনেকটা এক-কাঁটাওয়ালা ছোট ঘড়ির মতো দেখতে যন্ত্র। যে রোগীর যে পরিমাণে অক্সিজেন প্রয়োজন, ওই কাঁটায় তা মেপে জোগানো হয় তাঁকে। এই যন্ত্র না-থাকায় ওই দুই রোগীকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন দিতে না-পারার কথা স্বীকার করে সরকারি হাসপাতালটির সুপার রঞ্জন দাস বলেন, ‘‘যথেষ্ট সংখ্যক ফ্লো-মিটার না-থাকায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। দু’জনের মৃত্যু হয়েছে।’’ অভিযোগ, অক্সিজেনের অভাবে নাকাল আরও অনেক রোগী।
প্রশ্ন উঠেছে, অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত থাকা সত্ত্বেও ফ্লো-মিটার রাখা হয়নি কেন? এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কেনই বা আগেভাগে তার বরাত দেওয়া হয়নি?
রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘এক মাস ধরে ফ্লো-মিটারের বরাত দিয়েও কোথাও তা পাচ্ছি না। বিদেশে বরাত দিলেও আসছে না।... মঙ্গলবার কয়েকটি ফ্লো-মিটার ওই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, তার অভাব এ বার দ্রুত ঘুচবে।’’ ঘটনা প্রসঙ্গে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা আগেই বিদ্যাসাগর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। যাতে অক্সিজেনের জোগান, রেগুলেটরের সংখ্যা বাড়ানো যায়। সেই কাজ কিছুটা এগিয়েছে। কিছু যন্ত্রও এসেছে। প্রয়োজন হলে তা আরও বাড়ানো হবে। প্রধান লক্ষ্য, অক্সিজেনের পর্যাপ্ত জোগান।’’
সমস্যার মূল কারণ হিসেবে অবশ্য অতিমারিতে হাসাপাতালের চিকিৎসা-পরিকাঠামোর উপরে অস্বাভাবিক চাপের দিকে আঙুল তুলছেন সুপার। তাঁর কথায়, ‘‘সারি (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইলনেস) ওয়ার্ডে ৩৪টি শয্যা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে রাখা হয়েছে আরও ১০টি বাড়তি শয্যা। কিন্তু রোগী ভর্তি তার থেকেও অনেক বেশি হলে, সামাল দেব কী করে?’’ সুপারের দাবি, ফ্লো-মিটার পেতে স্বাস্থ্য ভবনে আগেই বরাত দেওয়া হয়েছিল। শেষমেশ মঙ্গলবার ১৫টি এসেছে।
তবে হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, সমস্যা শুধু ফ্লো-মিটার নয়। ভর্তি হতে চাওয়া রোগীর সংখ্যার যা চাপ, তা সামাল দেওয়া কঠিন হচ্ছে এখনকার পরিকাঠামোয়। সূত্র জানাচ্ছে, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী সরকারি হাসপাতাল ভর্তি হতে আসা কোনও রোগীকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। ফলে বিদ্যাসাগর হাসপাতালেই ‘সারি’ ওয়ার্ডের ৪৪টি শয্যায় রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০! অধিকাংশ শয্যাতেই দু’জন করে রোগী। সামলাতে নাজেহাল হাসপাতাল। সূত্রের দাবি, শয্যা সংখ্যার অনুপাতে যথেষ্ট সংখ্যক ফ্লো-মিটার হাসপাতালে ছিল। কিন্তু শেষ দু’তিন দিনে প্রায় প্রতি শয্যায় দু’জন করে রোগী থাকতে শুরু করায় তার ঘাটতি দেখা দিয়েছিল।
যাঁদের বাড়ির লোক মারা গিয়েছেন, পরিকাঠামো ঘাটতির এই হিসেব-নিকেশে তাঁদের মাথা দিতে না-চাওয়াই স্বাভাবিক। তাই হাসপাতালের উপরে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন তাঁরা। জানাচ্ছেন, মনোয়ারা বেগম এবং যমুনা নাথ ভর্তি হওয়ার সময়েই তাঁদের শ্বাসকষ্ট ছিল। সেই সময়ে তাঁদের করোনা পরীক্ষা হয়নি। মঙ্গলবার তা করানোর কথা ছিল।
মনোয়ারার বোন পারভিন বেগমের অভিযোগ, ‘‘রবিবার সকালে দিদিকে হাসপাতালে ভর্তি করি। সে দিন অক্সিজেন দেওয়া হয়নি। সোমবার সকালে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় তা দেওয়া হয়।... সোমবার মাঝরাতে দিদি মোবাইলে ফোন করে জানায়, অক্সিজেন খুলে নেওয়া হয়েছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ গিয়ে দেখি, দিদি কাতরাচ্ছেন। নার্স, চিকিৎসক কেউ নেই। সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ দিদি মারা যান।’’
যমুনা নাথের ছেলে সুমনের অভিযোগ, ‘‘সোমবার ভোরে ভর্তি করেছিলাম। দুপুর ১২টা পর্যন্ত একটিই সিলিন্ডার থেকে ৫-৬ জন রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছিল। অথচ মায়ের করোনা পরীক্ষা তখনও হয়নি।’’ অক্সিজেন দিতে একই মাস্ক একাধিক রোগীর মুখে দেওয়া হচ্ছিল বলেও তাঁর অভিযোগ। সুমনের বক্তব্য, ‘‘সোমবার বেলায় আলাদা সিলিন্ডার দেওয়া হয়। কিন্তু ওই দিন রাত তিনটে নাগাদ মায়ের কাছে থাকা মাসি ফোনে জানান, অক্সিজেন খুলে নেওয়া হয়েছে। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ মায়ের মৃত্যু হয়।’’
হাসপাতাল অবশ্য এই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। রঞ্জনের দাবি, ‘‘এ সব অভিযোগ ঠিক নয়। এক মাস্ক কখনও একাধিক জনকে দেওয়া হয় না। ফ্লো-মিটারের সমস্যা ছিল। সেই সমস্যা মঙ্গলবার দুপুর থেকে মিটে গিয়েছে।’’ হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, ভর্তি থাকা বহু রোগীর অবস্থাই সঙ্কটজনক। ফলে অনেক ক্ষেত্রে যাঁরা সব থেকে বেশি সঙ্কটে, অক্সিজেনের নল অন্যের থেকে নিয়ে বাধ্য হয়ে তাঁদের দিতে হচ্ছে।
কিন্তু দুই পরিবারের সদস্যদেরই প্রশ্ন, এই মৃত্যুর দায় কার? তাঁদের দাবি, ‘‘ফ্লো-মিটার মজুত না-রাখার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া হোক।’’
অজয় বলছেন, ‘‘এই ঘটনায় কারও শাস্তি হলে, আগে আমাকেই তা মাথা পেতে নিতে হবে।’’ কিন্তু অতিমারির এই প্রবল সঙ্কটে সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে রোগীর অস্বাভাবিক চাপ কী ভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব, সেই প্রশ্ন বার বার তুলছে হাসপাতাল সূত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy