(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অমিত শাহ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
অমিত শাহ যখন ধর্মতলার মঞ্চে, তখন রাজ্য বিধানসভায় বক্তৃতা করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কাকতালীয় ভাবে, অমিত যখন তাঁর বক্তৃতা শুরু করছেন, তার অব্যবহিত আগে মমতা তাঁর বক্তৃতা শেষ করেছেন। অমিত যখন তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা শেষ করে মঞ্চ ছেড়ে যাচ্ছেন, তার প্রায় কাছাকাছি সময়ে মমতা যোগ দিয়েছেন বিধানসভা চত্বরে অম্বেডকর মূর্তির পাদদেশে তৃণমূল বিধায়কদের ধর্না-অবস্থানে। যেখানে বুধবার দলের নির্দেশে সকলে কালো পোশাক পরে হাজির হয়েছিলেন।
মমতার ২১ জুলাইয়ের সভাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়ে ধর্মতলায় ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভা করার প্রস্তুতি নিয়েছিল রাজ্য বিজেপি। তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, ভিড়ের বহরে মমতার বার্ষিক শহিদ সমাবেশকে ছাপিয়ে যাওয়া। সমাবেশের আগে যে হুঙ্কার রাজ্য বিজেপির নেতারা দিতে শুরু করেছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল, তাঁরা মমতাকে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি।
বস্তুত, বিজেপির ওই চড়া সুরের ফলে খানিকটা ‘শঙ্কিত’ হয়েছিল শাসক তৃণমূলের একাংশ। কারণ, বিজেপির ওই সভায় ‘বাধা’ দিয়েছিল প্রশাসন। অনুমতি দিয়েছিল আদালত। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় যে রাজ্য বিজেপিকে ‘শক্তিশালী’ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
তৃণমূলের বার্ষিক সমাবেশের জায়গায় সভা করতে চেয়ে লালবাজারের অনুমতি চেয়েছিল বিজেপি। পুলিশ অনুমতি দেয়নি। সিঙ্গল বেঞ্চে মামলা করে প্রথমে সভা করার ছাড়পত্র পায় বিজেপি। কিন্তু ‘নাছোড়বান্দা’ মনোভাব নিয়ে রাজ্য সরকার সেই রায় চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায়। সেখানে সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশই বহাল থাকে। ডিভিশন বেঞ্চ তাদের পর্যবেক্ষণে বলে, অন্য দল সভা না করতে পারলে ২১ জুলাইয়ের সভাও বন্ধ করে দেওয়া হবে! তবে তৃণমূল সরকার যে বিজেপির সভায় ‘বাধা’ দিয়ে ঠিক করেনি, তা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এর ফলে চার আনার নকুলদানার পার্টি বিজেপি ১২ আনার প্রচার পেয়ে গেল।’’
তৃণমূল বাধা দিয়ে ভুল করেছিল। আর বিজেপি ভুল করল ২১ জুলাইয়ের সভার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে!
অনেকেই বলছেন, বিজেপি জেদ ধরে রেখে ধর্মতলায় সভা করে ভুল করল। মমতাকে তাঁর ‘শক্তি জমি’তে চ্যালেঞ্জ জানাতে গেলে আরও জোর দেওয়া উচিত ছিল। ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে সভা করায় জেদ ধরে রেখে বিজেপি আসলে নিজেদেরই কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। তুলনাটা তারাই অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। সেই সিদ্ধান্ত ‘হঠকারী’ ছিল কি না, তা নিয়ে দলের অন্দরে আলোচনা হবে কি না, তা নেতারই বলতে পারবেন। কারণ, দিনের শেষের রিপোর্ট কার্ড বলছে, সভা জমেনি। সেই সঙ্গে সাংগঠনিক অনেক ‘দুর্বলতা’ও বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। মমতার সমাবেশের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, প্রধান বিরোধী দলের ফুটোফাটা প্রচুর! বস্তুত, মমতা নিজেও সম্ভবত ভাবছেন, কেন বিজেপিকে ‘বাধা’ দেওয়া হয়েছিল!
অনেকে বলবেন, মমতার সভা ‘প্রশাসনিক সহায়তা’ পেয়ে থাকে। সেটা যে খুব ভুল, তা-ও নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ২১ জুলাইয়ের সভা প্রশাসনিক ‘সহায়তা’ পাচ্ছে ২০১১ সাল থেকে। ১৯৯৩ সালের ঘটনার পর ১৯৯৪ সাল থেকেই ওই দিন শহিদ দিবস পালন করেন মমতা। কিন্তু ভরা বাম আমলেও তাঁর ডাকে আগত ভিড় এত ছন্নছাড়া ছিল না!
ভিড়: তৃণমূল ১০/১০, বিজেপি ১০/৪
ধর্মতলায় বুধবারের জমায়েত নিয়ে নানাবিধ দাবি থাকতে পারে বিজেপির। যেমন অনেক নেতা বলছেন, ‘‘দারুণ সভা!’’ আবার শাসক তৃণমূলও বলতে পারে ‘‘লোক হয়নি’’ বা ‘‘সুপার ফ্লপ শো।’’ কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে খুব নরম ভাবে বললেও ভিড়ের নিরিখে বিজেপির সভা মমতার সমাবেশের কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি! হারানো তো অনেক দূরের কথা। একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কত লোক হয়েছে, তা বোঝার অন্যতম সূচক জনজীবনে তার ‘প্রভাব’। রাজনীতিকেরা যখনই দুর্ভোগের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমা চান, তাঁরাও জানেন, জনতার দুর্ভোগ না-হলে কর্মসূচির সাফল্য হয় না। মানুষ নাজেহাল না-হলে শক্তিপ্রদর্শন করা যায় না। সেই সূচকে ভরা বর্ষার ২১ জুলাই ১০-এ ১০ পাবে। বিজেপির সভাকে টেনেটুনে পাসমার্ক— ৪।
মেট্রোয় ঠাসাঠাসি ভিড় দেখা যায়নি। ধর্মতলা সংলগ্ন বিভিন্ন ছোটখাট রাস্তাও ঠিকঠাক। মাইকের আওয়াজ শোনা গেলেও জনস্রোতের ঝাপ্টা লাগেনি। সকাল সাড়ে ১১টার পরেও লেনিন সরণিতে বাস চলাচল স্বাভাবিক ছিল। তার পরে আস্তে আস্তে তা বন্ধ হয়। এসএন ব্যানার্জি রোড দিয়ে ডোরিনা ক্রসিং, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ হয়ে যে গাড়িগুলি বাবুঘাট বা হাওড়ার দিকে গিয়েছে, ১২টার পর পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল তাদের চলাচল। তখন মঞ্চে বক্তৃতা শুরু হয়ে গিয়েছে। ২১ জুলাই সকাল ৭টা থেকে মঞ্চের সামনে ঠাসাঠাসি ভিড় শুরু হয়। বিজেপি নেতাদের অবশ্য বুধবার একাধিক বার মঞ্চ থেকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘পুলিশ মিছিল আটকাচ্ছে!’’ তবে তেমনকিছু কারও নজরে পড়েনি।
স্বতঃস্ফূর্ততা: তৃণমূল ৮.৫/১০, বিজেপি ৩.৫/১০
এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, তৃণমূলের কাছে ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ পুরোপুরি আবেগের। একইসঙ্গে এ-ও প্রণিধানযোগ্য যে, কুড়ি বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর স্বতঃস্ফূর্ততা খানিকটা কমতে বাধ্য। তবে যেটুকু কমেছে, সেটুকুর জায়গা নিয়েছে শক্তিশালী সংগঠন। বস্তুত, নির্বাচনের বছরগুলিতে ওই শহিদ সমাবেশ ‘বিজয় সমাবেশ’-এরও রূপ নিয়েছে। যাতে শক্তিপ্রদর্শনও থাকে বৈকি। ১৯৯৩ সালে যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল ধর্মতলার রাজপথে। ফলে পরিমাণ কমলেও স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের ঘাটতি হয় না তৃণমূলের সমাবেশে। তার সিকি ভাগও বুধবার বিজেপির সভায় দেখা যায়নি। বরং মঞ্চের সামনে গেরুয়া চেয়ারে বসা বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের দেখা গিয়েছে, পরিপাটি সাজগোজ করে তাঁরা সমাবেশে এসেছেন। যার সঙ্গে লড়াইয়ের ‘মেজাজ’ খাপ খায় না। স্বতঃস্ফূর্ততায় ২১ জুলাই যদি ১০-এ সাড়ে ৮ পায়, তা হলে বিজেপিকে দরাজ হাতে নম্বর দিলেও সাড়ে ৩-এর বেশই দেওয়া যাচ্ছে না।
বক্তৃতা: তৃণমূল ৮/১০, বিজেপি ৫/১০
যে কোনও রাজনৈতিক সভায় বক্তা বাছাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। গোড়ার দিকে একটু গরম গরম ভাষণ, মাঝে খানিক তত্ত্বকথা তার পর শেষে মূল আকর্ষণ— মোটামুটি এ ভাবেই তালিকা তৈরি করে থাকে রাজনৈতিক দলগুলি। সে ব্রিগেডই হোক বা অন্যত্র কোনও সমাবেশে। বুধবার বিজেপির শুরুটাই ছিল ঝিমিয়ে-পড়া। প্রথম পাঁচ বক্তা চন্দনা বাউড়ি, মাফুজ়া খাতুন, খগেন মুর্মু, মনোজ টিগ্গা, রাজু বিস্তা পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে কী বলেছেন, তা হয়তো অনেকেরই সভার পরে মনেও থাকবে না। বক্তাদের ভাষণ শুনে মনে হয়েছে, তাঁরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খাতা জমা দিতে পারলেই কৃতার্থ হবেন। তৃণমূলের সভাতেও বক্তাদের সময় বাঁধা থাকে। কিন্তু তার মধ্যেও গুরুত্ব অনুযায়ী বেশি-কম থাকে। বিজেপির সভায় সকলেরই পাঁচ মিনিট! আক্রমণাত্মক বক্তা হিসেবে পরিচিত শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ভাঙাগলায় শুভেন্দু কী বলছেন, তা প্রায় শোনাই যায়নি। অনেক সাংসদ, বিধায়কের বক্তৃতা শুনে মনে হয়েছে, বিষয় নির্বাচন করে সুচিন্তিত ভাবে বলা বা ভাষণের শৈলী রপ্ত করায় ঘাটতি রয়েছে। তবে লকেট চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পাল, শমীক ভট্টাচার্য পরিণত বক্তব্য পেশ করেছেন। বক্তাদের পারফরম্যান্সে ২১ জুলাই ১০-এ ৮ পেলে বিজেপিকে বড়জোর ৫ দেওয়া যেতে পারে।
রাজনৈতিক অভিমুখ: তৃণমূল ৮/১০, বিজেপি ৫/১০
ধর্মতলার সভা থেকে কী নিয়ে ফিরলেন বিজেপি কর্মীরা? বেশির ভাগ বক্তাই ২০২৪-এর লোকসভার সঙ্গে ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটের স্বপ্ন ফেরি করতে চাইলেন। এমনকি, ‘প্রধান বক্তা’ অমিত শাহও হাঁটলেন একই পথে। যে শাহ কয়েক মাস আগে বীরভূমের সভা থেকে বলেছিলেন, ‘‘লোকসভায় বাংলায় বিজেপি যদি ৩৫টি আসন পায়, তা হলে ২০২৬ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। ২০২৫ সালেই মমতাদিদির সরকার বিদায় হয়ে যাবে’’, সেই শাহ বলেছেন, ২০২৬-এ তৃণমূল সরকারের বিদায় নিশ্চিত। আর বলেছেন, লোকসভা ভোটে এমন সংখ্যক আসন দিন, যাতে ‘মোদীজি’ বলতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। অর্থাৎ, ২০২৫ সালের বিষয়টি আর উচ্চারণ করেননি তিনি। পাশাপাশি, ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যের কথা বলেন। কোনও বার তা পঞ্চায়েত, কোনও বার বিধানসভা, কোনও বার লোকসভা। সেই সঙ্গে ঘোষিত হয় সাংগঠনিক বার্তাও। সে দিক থেকে ২১ জুলাই ১০-এ ৮ পাবে। ২৯ নভেম্বর বড়জোর ৫।
চমক: তৃণমূল ৮/১০, বিজেপি ৩.৫/১০
প্রায় প্রতি বছরই ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে কোনও না কোনও চমক থাকে। সে তারকা উপস্থিতি হোক বা যোগদান বা বক্তা। বিজেপির সভা চমকহীন। যে অভিনেত্রীদের ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে প্রার্থী করেছিল গেরুয়া শিবির, তাঁদেরও কাউকে দেখা যায়নি। ব্রিগেডে নরেন্দ্র মোদীর সভায় তবু মিঠুন চক্রবর্তীর যোগদান ছিল। বুধবারের মঞ্চে দেখা মেলেনি তাঁরও। চমক দেওয়ার নিরিখে ২১ জুলাই ১০-এ ৮ পেলে বিজেপির সভা পাবে মেরেকেটে সাড়ে ৩ পাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy