প্রতীকী ছবি।
তিন দিকে কাঁধ-সমান উঁচু প্লাইউডের ঘেরাটোপ। ভিতরে সস্তার কাঠের বেঞ্চ।
সামনের পর্দায় চলবে সিনেমা। হাফ টাইমে বাদামওয়ালা, চপওয়ালাদের প্রবেশ নিষেধ। লাইটম্যানদের অযথা টর্চ ফেলে কৌতুহল দেখানো বারণ।
প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য দু’তিন ঘণ্টার নিভৃত আস্তানা, গ্রামবাংলার সিনেমা হলের এই বক্স।
আরও পড়ুন: লেভেল ক্রসিংয়ে বন্ধু হবে সাইরেন
সাধারণ সিটের তুলনায় খরচ বেশি বক্সে। দু’জন পুরুষ বা দু’জন মহিলা সঙ্গী ঢোকার অনুমতি নেই। অন্য সিটের জন্য যেখানে ২৫-৩০-৫০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়, সেখানে বক্সের এক জোড়া টিকিটের দাম পড়ে ২০০-৩০০ টাকা।
বক্সের টিকিট বেচে সামান্য লাভের মুখ দেখার চেষ্টায় থাকেন গ্রাম-মফস্সলের সিনেমা হল মালিক। শহুরে যুগলের জন্য যেমন আছে মাল্টিপ্লেক্সের শৌখিন গোল্ডক্লাসের নির্জনতা, নলবনের নিভৃতি, গ্রামের ছেলেমেয়েদের ভরসা রঙচটা বক্সে দু’তিন ঘণ্টার সান্নিধ্য।
কিন্তু এ বার তার উপরে পড়েছে প্রশাসনের নজর। গত ৩০ জুন উত্তর ২৪ পরগনার সিনেমা হলগুলিকে বক্স বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন হঠাৎ বক্সের নির্জন অন্দরে নজর পড়ল পুলিশ-প্রশাসনের?
বছর দেড়েক আগে বাদুড়িয়ার একটি সিনেমা হলের বক্সে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। বসিরহাটে বক্লের ভিতরে এক মহিলার শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়েরা ঢোকে বক্সে, এমন অভিযোগও বিরল নয়। সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যৌনকর্মীদের নিয়ে অনেকে ঢোকেন বক্সে। এ সব অভিযোগের প্রেক্ষিতেই বক্সের উপরে নজরদারি শুরু করে পুলিশ। দিন কয়েক আগে অশোকনগরের একটি হল থেকে পুলিশ কয়েকজনকে ধরে। মঙ্গলবার, স্বাধীনতা দিবসের দিন বাদুড়িয়ার কাটিয়াহাটের একটি সিনেমা হলে হানা দিয়ে ১০ জোড়া ছেলেমেয়েকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রেক্ষাগৃহের এক কর্মীও গ্রেফতার হন।
পুলিশের বক্তব্য, বক্সের টিকিট বিক্রি করতে গেলে সিনেমা হল মালিকের নির্দিষ্ট অনুমতি লাগে। সে সব না থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তা ছাড়া, বক্সের ভিতরে অশালীন আচরণ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে নানা সময়ে। বক্স বন্ধের সেটাও একটা কারণ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, পুলিশের এই আচরণ কি ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়?
বাদুড়িয়ার এক যুবক বলেন, ‘‘বক্সে বসে কেউ প্রেম করলে কী দোষ? সিনেমা হলের বাইরের জগতের আইন-শৃঙ্খলার দিকটা দেখুন না প্রশাসনের কর্তারা!’’ হাবরার বাসিন্দা মধুরিমা মজুমদারের কথায়, ‘‘আমি নাবালক নই। কোথায় কার সঙ্গে যাব, কী ভাবে বসব, কী করব— তা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের এত মাথাব্যথা কীসের?’’
সিনেমা হল মালিকদের যুক্তিও ফেলনা নয়। হাবরার এক হলমালিকের কথায়, ‘‘এমনিতেই ইন্টারনেট, ডিভিডি, পেনড্রাইভের যুগে লাভের মুখ দেখার দিন শেষ। বক্সের টিকিট বেচে তবু কিছু টাকা আসত। এ বার মনে হয় সব লাটে উঠবে।’’
উত্তর ২৪ পরগনায় কয়েক বছর আগেও একশোর বেশি সিনেমা হল ছিল। কমতে কমতে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৪৩টিতে। মাল্টিপ্লেক্স ৪টি। সল্টলেক, রাজারহাট, দমদম ও বারাসত। ৪৩টি সিনেমা হলের মধ্যে সব ক’টিতে বক্স নেই। তবে সকলেই ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত ‘খাঁড়ার ঘা’ বলেই মনে করছেন বেঙ্গল মোশান পিকচার্স এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক শিবু দাস। তিনি বলেন, ‘‘কাপল সিটে (বক্স) তবু একটু বিক্রি-বাট্টা হত। এখন কী হবে, কে জানে।’’
প্রশাসন অবশ্য সিদ্ধান্তে অনড়। জেলাশাসক অন্তরা আচার্য বলেন, ‘‘বক্সের ভিতরে অসামাজিক কাজ হয় বলে জানা গিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। সেই সমস্যা এড়াতেই এই সিদ্ধান্ত।’’
সহ প্রতিবেদন: নির্মল বসু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy