(বাঁ দিকে) ধৃত তাজিমুল ইসলাম। ভাইরাল হওয়া ভিডিয়ো থেকে নেওয়া ঘটনার ছবি (ডান দিকে)। —সংগৃহীত।
মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘যে ঘটনা ঘটেছে তা নিন্দনীয়। যদিও পুলিশ ব্যবস্থা নিতে দেরি করেনি। অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যে মহিলার উপর আক্রমণ হয়েছে, তাঁকেও নিরাপত্তা দিয়েছে প্রশাসন। তবে আমি মনে করি, মানুষেরও প্রতিবাদ করা উচিত! ইদানীং অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের ঘটনা ঘটলে দেখা যাচ্ছে, চোখের সামনে অপরাধ হলেও অনেকে প্রতিবাদ না করে দেখছেন। ছবি তুলছেন। এটা কাম্য নয়।’’
বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের কথায়, ‘‘ওই ঘটনা যাঁরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, ভিডিয়ো তুলে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন কিন্তু প্রতিবাদ করলেন না, তাঁরা আমাদের রাজ্যের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতীক। সবাই সব দেখছেন। কিন্তু মুখ খুলছেন না।’’
সিপিএম নেত্রী কনীনিকা ঘোষ বোস বলেছেন, ‘‘ওই এলাকায় তৃণমূলের সন্ত্রাসের জন্যও মানুষ চুপ করে থাকতে পারেন। প্রতিবাদ করলে তাঁদের উপর নতুন আক্রমণের ভয় কাজ করে থাকতে পারে।’’
যাঁকে নিয়ে এত কাণ্ড, তাঁর নাম তাজিমুল ইসলাম। ডাক নাম ‘জেসিবি’ (বুলডোজ়ার প্রস্তুতকারক ওই সংস্থার নামেই বুলডোজ়ারকে ডাকা হয়)। সে নামের মান রেখেছেন চোপড়ার তৃণমূল নেতা! বুলডোজ়ার যেমন গুঁড়িয়ে, পিষে দেয় সামনে থাকা বস্তুকে, তিনিও তেমনই শক্তি নিয়ে প্রণয়ী যুগলকে পিষেছেন। উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার হোমরাচোমরা তৃণমূল নেতার কীর্তি গোটা দেশ জেনে গিয়েছে। ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়ো (ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) ঘিরে সোমবার সংসদও তোলপাড়।
দুনিয়া দেখেছে বাংলার এক গ্রামে ‘মধ্যযুগীয় শাসন’। জনতার আদালতে শাস্তি। সবাই দেখেছেন, জেসিবি যখন ওই যুগলকে পেটাচ্ছেন, মহিলার চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফেলছেন, এলোপাথাড়ি লাথি মারছেন, তখন গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে তা দেখছেন স্থানীয়েরা। কেউ কেউ মারধরে সঙ্গতও করছেন। তবে বেশির ভাগই দেখতে ব্যস্ত। কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কেউ আবার উৎসাহ ধরে রাখতে না পেরে আশপাশের বাড়ির কার্নিসে উঠে পড়েছেন। চোপড়ার ভাইরাল ভিডিয়োটি দেখলে বোঝা যাচ্ছে, সেটি উঁচু কোনও জায়গা থেকে তোলা। কিন্তু যাঁরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুগলকে পেটানো দেখলেন বা ভিডিয়ো তুললেন, তাঁরা কারা? কেন তাঁরা ঘটনাটা থামালেন না? তাঁরা কি মজা দেখছিলেন? না কি ভয় পাচ্ছিলেন?
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হচ্ছে, সম্প্রতি গণপ্রহারের কিছু ঘটনা কানে আসছে। এটা হয়তো তারই অঙ্গ। তাঁর কথায়, “এই ধরনের ঘটনায় মানুষ ঘটনাটি আটকানোর ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকছেন। কিন্তু ক্যামেরাবন্দি করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন। কোথাও যেন মানুষ এর মধ্যে বিনোদনমূলক অংশও খুঁজে পাচ্ছেন। আমাদের মধ্যে যে আদিম হিংস্র প্রবৃত্তি রয়েছে, গণপ্রহার সেই প্রবৃত্তিকে উস্কানি দেওয়ার পরিসর খুলে দেয়। এটা তারই নিদর্শন।” কিন্তু ভিডিয়ো তোলা কেন? অনুত্তমার বক্তব্য, সমাজমাধ্যমে প্রদর্শনের ঝোঁক এত বেড়ে গিয়েছে, যার ফলে মানুষের একটি অংশের হিতাহিত জ্ঞান থাকছে না যে, তাঁরা কী করছেন। প্রাথমিক নাগরিক কর্তব্য থেকেও মানুষ চ্যুত হচ্ছেন। কিসের মূল্যে এই প্রদর্শন, সেই জায়গাটিও ক্রমশ লঘু হয়ে যাচ্ছে বলে অভিমত তাঁর।
চোপড়ার তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমান (জেসিবি তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই এলাকায় পরিচিত) বলেছেন, ‘‘শাসন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।’’ তৃণমূলের সঙ্গে যে তাঁর যোগ রয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন হামিদুল। যে হামিদুলকে কিছু দিন আগেই ‘পাওয়ারফুল’ আখ্যা দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হামিদুল দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তৃণমূল নিন্দা করেছে। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন উঠছে, মানুষ কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন? ভিডিয়ো উঠল, কেন প্রতিবাদের স্বর উঠল না অকুস্থলে?
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের নেতাদের কুকথা নিয়ে অতীতে সমালোচনার ঝড় বয়েছে। সে অধুনাপ্রয়াত তৃণমূলের তাপস পাল হোন বা সিপিএমের অনিল বসু। সেই সব ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, একদল লোক হাততালি দিচ্ছেন। আবার সংসদে যখন মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের স্তুতি করেছেন বিজেপির প্রজ্ঞা সাধ্বী, তখনও দেখা যায়নি তাঁর দলের কেউ প্রতিবাদ করেছেন। এই গণদর্শক এবং গণশ্রোতা কি একই গোত্রের?
এই প্রসঙ্গে অনুত্তমা মণিপুরের মহিলাদের নগ্ন করিয়ে প্যারেড করানোর ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, “মানুষের উত্তেজিত হওয়ার রসদ বোধ হয় ফুরিয়ে আসছে। তাই এই ধরনের ঘটনাকেও মানুষ ব্যবহার করে ফেলছেন। আমরা একে অপরের হাতে কোথায় ব্যবহৃত হয়ে যাচ্ছি, আমরা নিজেরাই ভাবছি না। গণপিটুনির ঘটনা যখন ঘটছে, তখন গণদর্শকও তৈরি হচ্ছে। যাঁরা নিশ্চুপ হয়ে দেখছেন বা ভিডিয়ো তুলছেন, তাঁদের ভূমিকাটা কিন্তু ভয়জনক!’’
(চোপড়ার ঘটনায় ধৃত তাজিমুলের নাম আমরা ‘তাজম্মুল’ লিখছিলাম। এফআইআরে তাঁর নাম ‘তাজিমুল’ বলে উল্লিখিত আছে। আমরা সেই নামই লিখছি)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy