Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Tarkeshwar

ভোলানাথ থেকে মহাদেও হয়ে গিয়েছেন তারকেশ্বর, বাঁকের সঙ্গে এখন রথও ছুটছে হুগলির তীর্থ-পথে

এ বার শুধু শ্রাবণ নয়, তারকেশ্বরের মেলা ভাদ্র মাসেও। সে বদল তো পঞ্জিকার দৌলতে। কিন্তু ভক্তদের বদলও কি কম নাকি! তারকেশ্বর যাত্রার পথে পথে খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।

তারকেশ্বর যাত্রা যেন কার্নিভাল।

তারকেশ্বর যাত্রা যেন কার্নিভাল। নিজস্ব চিত্র।

পিনাকপাণি ঘোষ ও শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৩ ১৩:০৫
Share: Save:

বাংলার প্রধান তীর্থগুলির বেশির ভাগই গঙ্গার কাছাকাছি। কালীঘাট, গঙ্গাসাগরের পরেই রাজ্যের প্রধান তীর্থ হুগলির তারকেশ্বর। তারকেশ্বর কিন্তু গঙ্গা থেকে অনেকটাই দূরে। তবে ‘গঙ্গা পৌঁছে যান’ সড়কপথে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরে শিবের মন্দিরে। প্রথা অনুযায়ী, বৈদ্যবাটির নিমাই তীর্থঘাট থেকে ভক্তেরা ঘড়াভর্তি জল নিয়ে হেঁটে যান মন্দিরে। তবে সেই যাত্রা এখন অনেক বদলে গিয়েছে। ব্যক্তির থেকে ভক্তগোষ্ঠীর (কখনও বিভিন্ন আয়োজক ক্লাবের) হাতে গিয়ে সেই যাত্রায় এসেছে থিম থেকে ইউনিফর্ম নানা কিছু। তাদেরই উদ্যোগে গঙ্গা তারকেশ্বরে পৌঁছন রথে চেপে। ঘোষিত প্রতিযোগিতা না থাকলেও, বৈচিত্রে জলের রথ পাল্লা দেয় একে অপরের সঙ্গে।

কোনও রথ রেলের স্টিম ইঞ্জিনের মতো, কোনওটায় আসীন কালী বা জগন্নাথ। ভারতের বিখ্যাত সব মন্দিরের আদলেও অনেক রথ। সেই থিমের সঙ্গে মিলিয়ে আবার আয়োজক যাত্রীদের পোশাক। চুলের ছাটেও থিমের ছোঁয়া। সব মিলিয়ে খরচ কত হয়? হিসাব কষে চন্দননগরের শিবশঙ্কর ঝা বললেন, ‘‘আমরা সবাই একসঙ্গে পোশাক প্রিন্ট করিয়ে নিই, এক একজনের খরচ আড়াইশো টাকা মতো পড়ে। এর পরে চাঁদা পাঁচশো টাকা। এর পরে নিজের নিজের খরচ। সব মিলিয়ে হাজারের উপরেই হবে। নেশার টাকা আলাদা।’’

শুধুই রথ নয়, সাবেক বাঁকেও এসেছে অনেক বদল। দিন দিন তার দৈর্ঘ্য বাড়তে বাড়তে এখন এক-একটি ফুট দশেকেরও রয়েছে। তার সাজও অনেক। কেউ সাজিয়েছেন এলইডি আলোয়, কেউ ময়ূরের পালকে। শ্রাবণের যাত্রা মানে ভরা বর্ষা। কিন্তু কেউ কি কখনও ভেবেছে জল নিয়ে যাওয়া কলসিও পাবে ছাতা! এমন ছবিও দেখা গেল এ বারের তারকেশ্বর যাত্রায়। সেই ছাতাতেও কত বাহার। সব মিলিয়ে আজকের তারকেশ্বর যাত্রা যেন ‘কার্নিভাল’ হয়ে উঠেছে।

শ্রাবণ মাসকে বলা হয় শিবের মাস। আর সোম হল শিবের বার। সোমেই উপচে পড়ে তারকেশ্বর। তার আগের দুটো দিন শনি ও রবিতেও তারকেশ্বরগামী সব পথ গমগমে। যদিও সপ্তাহের বাকি সব দিনকেও পবিত্র বলেই মনে করেন অনেক ভক্ত। এ মন্দির যে খুব পুরনো তা নয়। ইংরেজি ১৭৯২ সালে প্রতিষ্ঠা। তবে হিন্দু ধর্মের ইতিহাসে রয়েছে উল্লেখ। ‘মহালিঙ্গার্চ্চন’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে— ‘‘ঝাড়খণ্ডে বৈদ্যনাথো বক্রেশ্বরস্তথৈবচ / বীরভূমৌ সিদ্ধিনাথো রাঢ়ে চ তারকেশ্বর।’’ শোনা যায়, একটা সময়ে দুর্গার দেশ বাংলায় গোরক্ষনাথ সম্প্রদায়ের মহান্তরা শিবসাধনার সূচনা করেছিলেন। যে সম্প্রদায়ের উত্তরসূরি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এমনটাও জানা যায় যে, উত্তর ভারতের দশনামী সাধুদের নিয়ে এসে তারকনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় তারকেশ্বরে। উদ্যোগী ছিলেন অযোধ্যা থেকে আসা দুই ভাই বিষ্ণুদাস ও ভারমল্ল।

বাঁকে চেপেও গঙ্গা পৌঁছয় তারকেশ্বরে। তবে নতুন দিনে নতুন রূপ তার।

বাঁকে চেপেও গঙ্গা পৌঁছয় তারকেশ্বরে। তবে নতুন দিনে নতুন রূপ তার। নিজস্ব চিত্র।

তারকেশ্বর যাত্রীরা কেন হিন্দিতে শিবের নাম নেন এর ইঙ্গিত কিছুটা হলেও এ থেকে বোঝা যায়। তবে ‘ভোলেবাবা পার করেগা’ থেকে এখন ‘হর হর মহাদেও’ ধ্বনি বেশি উচ্চারিত হয় ভক্তদের মুখে। তারকেশ্বরে বরাবরই উত্তর ভারতের প্রভাব থাকলেও এখন সেটা আরও বেড়েছে। বাংলায় বসবাসকারী অবাঙালিদের কাছে তারকেশ্বর অনেক কাছের। অন্তত শ্রাবণ মাসে। তবে চৈত্র-বৈশাখের শিব অনেকটাই বাঙালির। যাতে রয়েছে চড়ক-গাজন, সন্ন্যাসীদের বাণফোঁড়, আগুনখেলা, বঁটি-ঝাঁপ ইত্যাদি। ইতিহাস বলছে, তারকেশ্বর বাঙালির কাছে শ্রাবণের দেবতা হয়ে ওঠেন ১৯৭৭ সালের পরে। সেই বছরেই সন্ধ্যা রায় ও বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘বাবা তারকনাথ’ ছবি মুক্তি পায়। আজও সেই ‘অশ্রুসজল’ ছবির কতটা রেশ রয়েছে তা বোঝা গিয়েছিল, যখন ২০১৪ সালে রাজনীতিতে আসা সন্ধ্যা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রথমেই গিয়েছিলেন তারকেশ্বরের মন্দিরে। ওই ছবির দৌলতে বাঙালি ভক্তরা পেয়েছিলেন নতুন ধ্বনি— ‘‘ব্যোম ব্যোম তারক ব্যোম, ‌ভোলে ব্যোম তারক ব্যোম।’’

তারকেশ্বর এবং তাঁর ভক্তেরা কালে কালে বদলেছেন। গাঁ তারকেশ্বর এখন শহর। তবে শুরুর দিন থেকে এখনও তারকেশ্বর-যাত্রা মানে পরিশ্রম ও সহ্যক্ষমতার পরীক্ষা দেওয়া। একটা সময় পর্যন্ত এই মন্দিরে যাওয়ার জন্য একমাত্র হাঁটা পথই ছিল। ১৮৮৫ সালে শেওড়াফুলি থেকে তারকেশ্বর পর্যন্ত নতুন রেলপথ তৈরি হয়। হাঁটার রেওয়াজ রয়ে গিয়েছে। এখন সেটাই ব্রত। বাঁক কাঁধেই হোক বা রথ টেনে হাঁটার পথ তো আর কম নয়। এতটা পথের যাত্রা সহজ করতে অনেক যাত্রীই মদ, গাঁজার নেশা বুঁদ হয়ে যান। পথে প্রশাসনিক নজরদারির মধ্যেই চলে বিকিকিনি। উৎসব মাহাত্ম্যে মেলে ছাড়। রাজনৈতিক তৎপরতাও কি কম নাকি! এখনও অনেকেই কলকাতা থেকেই হাঁটা শুরু করেন। গোটা পথে বিশেষত শাসকদলের নেতা-কর্মীরা ‘সেবা’ আয়োজন করে থাকেন। তারকেশ্বর যাত্রায় যে হেতু উপবাসের বিষয় নেই তাই পথে লুচি-হালুয়া, রুটি-সবজি থেকে লজেন্স, লস্যির হরেক আয়োজন। আগে জলসত্র থাকত বৈদ্যবাটি পার করার পরে। এখন দু’পা অন্তর সেবাসত্র। বিশ্রাম নেওয়া, নেশা করার সুযোগ। অ্যাঙ্গাস জুট মিলের কর্মচারী সন্তু সরকার বলেন, ‘‘গত দু’তিন বছর ধরেই সাজসজ্জায় একটা বদল দেখা যাচ্ছিল। তবে এ বার সেটা সার্বিক আকার নিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা হল, শিবের সঙ্গে বজরংবলীও মিশে যাচ্ছে। এই শ্রাবণে জলযাত্রীদের মধ্যে হনুমানের ছবি সম্বলিত গেরুয়া পতাকার আধিক্য দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশিই, ঘট নেওয়ার বাঁকে জাতীয় পতাকা নেওয়ারও নতুন একটা হুজুগ তৈরি হয়েছে।’’

শ্রাবণ মানে তারকেশ্বরের পথে পড়া হুগলির সুরা বিক্রেতাদেরও মহোৎসব। বিক্রি বাড়ে লাফিয়ে। তবে ভোলেবাবার ভক্তেরা অনেকেই নেশার সরঞ্জাম নিয়ে বার হন। দলের কারও কাছে থাকে সেই বাক্স। বালি থেকে উত্তরপাড়া ঢোকার মুখে বসেছিলেন রামশঙ্কর সাউ। তিনি কথা বলতে বলতে দেখালেন তাঁর বাক্স। রামশঙ্কর বললেন, ‘‘কোথাও পাব কি পাব না তার অপেক্ষা রাখি না। এই দেখুন, গাঁজা কাটার ছুরি থেকে ছিলিম সব আছে।’’ কিন্তু পুলিশ ধরলে কী করবেন? রামশঙ্করের এক দোসর বললেন, ‘‘কী আবার করব, ভোলেবাবা পার করেগা।’’ সম্মিলিত ধ্বনি উঠল— ‘‘হর হর মহাদেও’’, ‘‘খেলা হবে’’। তবে একটা বাঁচোয়া যে, তারকেশ্বর যাত্রীদের ‘প্রেরণা’ দিতে ডিজে বক্সের দাপট এ বার তুলনায় কম। অনেক জায়গায় প্রথম দিকে থাকলেও স্থানীয়দের অভিযোগ পেয়ে তৎপর হয়েছে পুলিশ।

হেঁটে যাওয়া হলেও ফেরা ট্রেনে। রেলের কাছেও শ্রাবণে উপার্জনের উৎসব। রবি আর সোমবার ছ’জোড়া করে স্পেশাল ট্রেন চলছে। আর টিকিট বিক্রি? শ্রাবণী মেলা শুরুর দিনেই নাকি অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি হয়েছে ১৫ লাখ টাকার। তারকেশ্বরে এ বার মেলা অনেক লম্বা। শ্রাবণ মাসে দু’টি অমাবস্যা থাকলেও এ বার এটি ‘মলমাস’ নয়। কিন্তু তিথি যোগ থাকায় এটি ‘অধিকমাস’। জানালেন বৈদ্যবাটির বাসিন্দা তথা হিন্দু শাস্ত্রের গবেষক নবকুমার ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘মলমাসে যেমন পুজো দেওয়া যায় না, সেটা নয় অধিকমাসের ক্ষেত্রে।’’ ফলে তারকেশ্বরের মেলা হয়ে গিয়েছে দু’মাসের। শ্রাবণ এবং ভাদ্র দুই মাস ধরেই হবে উৎসব। মেলা শুরুর দিনে মন্দির কর্তৃপক্ষ শিবলিঙ্গে জল ঢালার চোঙা লাগায়। আষাঢ়ের পূর্ণিমায় (২ জুলাই) লাগানো হয়েছে চোঙা। থাকবে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ফলে এই বছরের শ্রাবণের তারকেশ্বর যাত্রা আরও অনেক ক’টা দিন চলার কথা।

ফলে আরও রথ আসবে। আরও যাত্রী আসবে। আশায় এই সময়ে বৈদ্যবাটি, শ্যাওড়াফুলিতে শিবভক্তদের জন্য পসার সাজিয়ে বসা ব্যবসায়ীরা। নতুন দিনের তারকেশ্বর যাত্রায় নতুন নতুন সামগ্রী এবং তার বাজার তৈরি হয়েছে। বৈদ্যবাটি গভর্মেন্ট কোয়ার্টার সংলগ্ন ছোট দোকানমালিক সঞ্জয় ঘোষ বলেন, ‘‘দুর্গাপুজো যেমন থিমে ঢুকে গিয়েছে, তেমন শ্রাবণের তারকেশ্বর যাত্রাতেও থিম সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে। চৈত্র মাসেও বহু মানুষ জল ঢালতে যান, তখন এই বিষয়টি দেখা যায় না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বাঁক সাজাতে খরচের যে আস্ফালন দেখা যাচ্ছে, তা কয়েক বছর আগেও ছিল না। সেই সঙ্গে মদ-গাঁজার ফোয়ারা তো আছেই।’’ একটি নামি খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থার বড় পদে কর্মরত শুভজিৎ ভক্ত আবার গোটা বিষয়টিকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বৈদ্যবাটি থেকে তারকেশ্বর পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ এই সময়টায় পয়সা রোজগার করছেন। পুজোর আগে তাঁদের কাছে এটা বোনাসের মতো।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Tarkeshwar Bhola Shankar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy