সুবিচারের অপেক্ষায় আরতি রায়। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
মাঝরাতে হানা দিয়ে ঘুমন্ত ছেলেটাকে ঘর থেকে টানতে টানতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্লাস ইলেভেনের সেই ছাত্রের ঠাঁই হয়েছিল পুলিশ লক-আপে। পাড়ুই-কাণ্ডে নিহত সাগর ঘোষের সম্পর্কিত ওই নাতিকে নিরপরাধ জানিয়ে ক’দিন আগেই রায় দিয়েছে সিউড়ি জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড।
কিন্তু, সে দিনের ‘মুক্তি’র আনন্দের চেয়ে আজ ঢের বেশি খুশি ওই ছাত্রের পরিবার। সাগর ঘোষ হত্যা মামলায় বুধবার কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে আদতে রাজ্য পুলিশের গায়েই একটা ‘থাপ্পড়’ বলে মনে করছেন তাঁরা। এবং বিচারপতি হরিশ টন্ডনের সিবিআই তদন্তের এই নির্দেশকে তাঁদের নৈতিক জয় হিসেবেই দেখছেন পাড়ুইয়ের বাঁধনবগ্রামের রায় ও ঘোষ পরিবার। কারণ, ওই ঘটনার জেরে ‘বিনা অপরাধে’ জেল খেটে তাঁরাই প্রথম দ্বারস্থ হয়েছিলেন হাইকোর্টের।
গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের সময়, ২১ জুলাই রাতে নিজের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হন বোলপুরের কসবা পঞ্চায়েতের নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগরচন্দ্র ঘোষ। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, ঘটনার পরে পাড়ুই থানার পুলিশ সাদা কাগজে জোর করে সই নিয়ে একটি এফআইআর দায়ের করায়। তাতেই কয়েক জন নিরপরাধ ব্যক্তির নাম ছিল। ওই ‘ভুয়ো’ অভিযোগের ভিত্তিতে সাগরবাবুর সম্পর্কিত ওই নাতি-সহ গ্রামের চার জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করে বলে অভিযোগ। ধৃতদের মধ্যে অন্যতম দুই ভাই নবকৃষ্ণ রায়, নেপাল রায় এবং তাঁর ছেলে মানস রায় হাইকোর্টে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে মামলা করেছিলেন। বর্তমানে তাঁরা জামিনে মুক্ত রয়েছেন।
হাইকোর্টে প্রথম আবেদনকারী নেপাল, নবকৃষ্ণ ও মানস রায়।—ফাইল চিত্র।
সে দিন রাতের কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না বাঁধ নবগ্রামের রায় পরিবার। পুলিশের উপরে ক্ষোভও তাঁদের যাচ্ছে না। এ দিন বাড়ি উঠোনে দাঁড়িয়ে নবকৃষ্ণবাবু বললেন, “আমরা প্রথম থেকে বলে আসছি সাগরবাবুর খুনের সঙ্গে আমাদের পরিবারের কোনও যোগ নেই। প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে পুলিশই নিরপরাধদের ফাঁসিয়েছে। তাই আমরাই প্রথম সিআইডি বা সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়েছিলাম।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকালেন স্ত্রী আরতিদেবীর দিকে। পরিবারের তিন তিনটে পুরুষ জেলে। সংসার সামলাতে হিমশিম খেয়েছেন হতভাগ্য ওই মহিলা। খড়ের চালার দাওয়াই বসে রান্না করতে করতে আরতিদেবী বলেন, “অভিশপ্ত ওই রাত এখনও আমাদের তাড়া করছে। মাঝরাতে পুলিশ লাথি মেরে ঘরের দরজা খুলল। যুবতী মেয়ে পুলিশের সামনে হাতজোড় করে বাবাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করছে। কিন্তু পুলিশ তাঁর নিরপরাধ বাবাকে মাঝরাতে টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গেল।” এই পুলিশি ‘নির্যাতনে’র বিচার চান তিনি।
একই বাড়ির চত্বরে আলাদা চালায় উনুনে খই ভাজছিলেন নেপালবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবী। তিনি দাবি করলেন, ওই রাতে বাড়ির পাঁচিল টপকে পুলিশ ঢুকেছিল। তাঁর প্রশ্ন, “আমরা কি সন্ত্রাসবাদী? তা হলে পুলিশকে মাঝরাতে ওই ভাবে কেন অভিযান চালাতে হল?” তিনি জানান, পুলিশ আর র্যাফ তাঁদের খড়ের চালার বাড়ির দোতলা থেকে নেপালবাবু এবং তাঁর ছেলে মানসকে টানতে টানতে নীচে নামিয়ে ছিল। কেন তাঁদের ধরা হচ্ছে, তার উত্তরই পুলিশ দেয়নি। সরস্বতীদেবীর ক্ষোভ, “ওঁদের বিনা দোষে জেল খাটতে হল। দু’জনের অপেক্ষায় আমার চোখের জল শুকিয়ে যেত।” ওই অভিজ্ঞতার সিবিআই অনন্ত প্রকৃত দোষীদের আড়াল করবে না বলেই তিনি আশা করছেন। কাজের সূত্রে বোলপুরে যাওয়ায় তাঁদের দু’জনের কাউকেই অবশ্য বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তবে, নবকৃষ্ণবাবু বললেন, “পুলিশ খুনের মত মারাত্মক অপরাধে পরিবারকে জড়িয়ে দিল। আমার ভাইপো (মানস) সাগরের বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা করত! কেন যে পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করল, আজও তার উত্তর পাইনি!”
এ দিন ঘরে ঢুকতেই ক্ষোভে ফুঁসে উঠলেন ২১ জুলাই রাতে ধৃত সাগরবাবুর ওই নাবালক নাতির পরিবার। রায় পরিবারের সঙ্গেও তাঁরাও হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ঘটনার পর থেকে সামাজিক ভাবে নানা হেনস্থাও হতে হয়েছে। ওই ছাত্রের মায়ের অভিযোগ, “কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াননি। এমনকী, আমরা সংবাদমাধ্যমকেও সঙ্গে পাইনি।” তবে, এ দিন হাইকোর্টের রায়ের পরে অনেকটাই স্বস্তি ফিরেছে ওই পরিবারে। তার ঠাকুমা বলেন, “নাতিকে ওরা টানতে টানতে নিয়ে গেল। কাঁচা ঘুমে ছেলে ঠিক করে তাকাতেও পারছিল না। কোনও কিছুর বোঝার আগেই অন্ধকার রাতে নিমিষের মধ্যেই পুলিশের ভারী বুটের শব্দ মিলিয়ে গেল।” সিবিআই এ বার আসল অপরাধীদেরই ধরবে বলে ওই নাবালকের পরিবারের বিশ্বাস।
সকাল থেকেই সরগরম ছিল কসবা বাজার। ওখানেই সেই বিতর্কিত সভা করেছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। কসবা পঞ্চায়েতের অফিসেই দেখা মিলল শঙ্করীদেবীর। হাইকোর্টে রায়ে খুশি হৃদয় ঘোষদের লড়াইয়ের অন্যতম সঙ্গী, বর্তমানে ওই পঞ্চায়েত প্রধান। তিনি বললেন, “আশা করছি এ বার নিরপেক্ষ তদন্ত হবে। অপরাধীরা ধরা পড়বে।” একই সুর পঞ্চায়তের নির্বাচিত নির্দল সদস্য রবিলাল সরেনের গলায়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য হৃদয়বাবুদের বাড়িতে যেতে পারেননি। ফোনে বললেন, “এ বার হৃদয়রা ন্যায্য বিচার পাবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy