—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কয়েকটি বদলি, সুরক্ষামূলক কিছু ব্যবস্থা, ভবিষ্যতের জন্য এক গুচ্ছ প্রকল্প আর প্রতিশ্রুতি। এটাই প্রাপ্তি? এতে কতটা নিরাময় হবে স্বাস্থ্য দফতরের গভীর অসুখ? ‘সিস্টেম’-এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি, তার সাফাই হবে কী ভাবে?
স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে এখন ঘুরছে এই প্রশ্ন। আর এই সূত্র ধরে সামনে আসছে ওষুধ-দুর্নীতি, আর জি করের ঘটনায় যে হিমশৈলের চূড়াটুকু উন্মোচিত হয়েছে মাত্র। অভিযোগ, এর সঙ্গে জড়িয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন। প্রশ্ন উঠছে, বছরের পর বছর যে দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের একাংশের জীবন বিপন্ন হয়েছে, সেই দুর্নীতিকে উপড়ে ফেলা যাবে কি?
আর জি করের চিকিৎসক-পড়ুয়া হাসপাতালের ওষুধের মান নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন তুলেছিলেন। হাসপাতাল সূত্রে খবর, তাঁর সহকর্মীরা বার বার সাবধান করার পরেও তিনি মুখ বন্ধ করেননি। দুই সতীর্থকে সঙ্গে নিয়ে অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ঘরে গিয়ে বলে এসেছিলেন, ওষুধের মান এবং কার্যকারিতা তলানিতে। এর বিহিত হওয়া প্রয়োজন। অভিযোগ, সন্দীপ তাঁকে বলেছিলেন, এত বেশি কথা বললে তাঁর আর পাশ করা হয়ে উঠবে না। এই কথোপকথনের সময়ে হাসপাতালের আরও দুই কর্তা সেখানে ছিলেন। তাঁদেরই এক জন আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, গত কয়েক মাসে ওষুধের মান নিয়ে বিভিন্ন বিভাগ থেকে ডাক্তার-নার্সরা অহরহ অভিযোগ তুলেছেন। ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু, ওষুধের কার্যকারিতা না-থাকায় রোগীর অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ হওয়া— এমন বেশ কিছু অভিযোগ অধ্যক্ষের টেবিলে জমা পড়েছিল। কিন্তু কোনওটি নিয়েই নাড়াচাড়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, জেনারেল সার্জারি এবং প্লাস্টিক সার্জারির কয়েক জন চিকিৎসক কিছু দিন আগে রোগী মৃত্যু নিয়ে সরব হন। কিন্তু বিষয়টি বেশি দূর এগোয়নি। এক শল্যচিকিৎসকের কথায়, “প্রাণে বাঁচতে হবে তো! ওষুধ নিয়ে বেশি মুখ খুললে প্রাণে মেরে দেওয়া হবে, এমন হুমকি দিয়ে ফোন পর্যন্ত এসেছে।”
তাঁরা কী নিয়ে মুখ খুলেছিলেন? ওই শল্যচিকিৎসক বলেন, “অস্ত্রোপচারের পরে যে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়, বহু ক্ষেত্রেই তা কাজ করছে না। সর্বোচ্চ মাত্রাও বিফলে যাচ্ছে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমনকি, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার যে তরল, অনেক সময়েই দেখেছি সেটা স্রেফ রঙিন জল, তার ব্যবহারে ওই জায়গাটি জীবাণুমুক্ত হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি করে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। অস্ত্রোপচার সফল হওয়ার পরেও কিছু রোগীকে হারিয়েছি আমরা। ডাক্তার হিসেবে নিজেদের প্রতি ধিক্কার জন্মাচ্ছে।”
অভিযোগ এসেছিল শিশু রোগ বিভাগ থেকেও। ‘ওষুধ কাজ করছে না। সুস্থতার পথে খানিকটা এগোনোর পরেও অনেক শিশুকে বাঁচাতে পারছি না আমরা’—হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, এমনকি স্বাস্থ্য ভবনেও জানিয়েছিলেন কয়েক জন চিকিৎসক। প্রাপ্তি? নীরবতা। চিকিৎসকদের একাংশের মতে, এই নিম্নমানের ওষুধগুলো মূলত এমন ক্ষেত্রে হয়, যার মান চটজলদি বোঝা যায় না। অ্যান্টিবায়োটিক, লিভারের ওষুধ, স্নায়ুর ওষুধ, প্যারাসিটামল ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ ধরনের অনিয়ম বেশি।
জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী, প্রত্যেক মেডিক্যাল কলেজে ফার্মাকো-ভিজিল্যান্স কমিটি থাকার কথা, যাদের কাজ ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটছে কি না, সেই বিষয়ে নজরদারি করা, কোনও মৃত্যুর পিছনে ওষুধের বিরূপ প্রভাব আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা, এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো। কিন্তু এই সব অভিযোগের ক্ষেত্রে কোনও হাসপাতালেই এই কমিটির অস্তিত্ব টের পাওয়া গিয়েছে বলে শোনা যায়নি।
অভিযোগ, গত কয়েক বছরে রাজ্যের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এটাই চেনা ছবি। সরকারি দরপত্রে অংশ নিয়ে, কাগজে-কলমে প্রতিযোগিতার বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে যে সংস্থাগুলি দায়িত্ব পায়, অভিযোগ উঠেছে, ঘুরপথে তাদের মধ্যেই ঢুকে পড়ে এমন কয়েকটি সংস্থা, যাদের এই সংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতা বা পারদর্শিতা নেই। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্সের তালিকাভুক্ত ওষুধ তো বটেই, পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতাল স্থানীয় স্তরে টেন্ডারের মাধ্যমে যে ওষুধ কেনে, সেখানেও এমন নানা অনিয়মের অভিযোগ। প্রশ্ন হল, অযোগ্য সংস্থা ঠাঁই পায় কী ভাবে? অভিযোগ, সেখানেও ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র প্রভাব চলে। এ ক্ষেত্রে সন্দীপ ঘোষ ও তাঁর কিছু শাগরেদ, স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশ ও কিছু ওষুধ সংস্থার আঁতাঁতের অভিযোগ সামনে এসেছে।
সরকারি হাসপাতালে ওষুধ কেনা হয় সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স (সিএমএস)-এর মাধ্যমে। টেন্ডার ডেকে বিশেষ কমিটির মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে। সমস্ত সরকারি হাসপাতাল প্রয়োজন অনুযায়ী সেই ওষুধ নেয়। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সেই বেছে নেওয়ার ব্যবস্থাতেই আছে বিস্তর গলদ। অথচ কাগজে-কলমে নিয়মের শেষ নেই। বিশেষ কমিটির তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় ‘এসেনশিয়াল ড্রাগ লিস্ট’। সেই কমিটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পাশাপাশি থাকেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা, স্বাস্থ্য অধিকর্তাও। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেই তালিকা সংশোধন, সংযোজন হয়। তার পরে টেন্ডার ডেকে দু’বছরের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় বিভিন্ন ওষুধের জন্য মনোনীত সংস্থাগুলিকে। টেন্ডার প্রক্রিয়াতেও আছে দু’টি ধাপ। টেকনিকাল টেন্ডার ও ফিনানশিয়াল টেন্ডার। টেকনিকাল টেন্ডারে আবেদনকারী সংস্থা সম্পর্কে বিশদ তথ্য থাকে। সেই তথ্য দেখে তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবে খোলা হয় ফিনানশিয়াল টেন্ডার। সেখানে সব চেয়ে কম দামে যারা দিতে পারবে, তাদেরই বেছে নেওয়া হয়।
তা হলে? স্বাস্থ্য কর্তারা অনেকেই প্রকাশ্যে আক্ষেপ করেন, সবচেয়ে কম দামের জিনিস কিনতে হয় বলেই এই দুরবস্থা। কিন্তু এই যুক্তি কি আদৌ ধোপে টেকে? “কোথাও বলা হয়নি ওষুধের মানের সঙ্গে আপস করে কম খরচে কিনতে হবে। মান যদি সন্তুষ্ট করতে না পারে, তা হলে অন্য সংস্থাকে (তারা সর্বনিম্ন দর না দিলেও) বেছে নেওয়া যায়। শর্ত একটাই, কেন সর্বনিম্ন দরের সংস্থাকে বাছা হল না, অন্যটিকে বাছা হল, তা কমিটিকে বুঝিয়ে বলতে হবে। বাস্তবে এই পদ্ধতি মানা হয়ই না”, বলছিলেন স্বাস্থ্য দফতরের এক প্রাক্তন কর্তা, যিনি অতীতে এই ওষুধ কেনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। তাঁর অভিযোগ, “ভুতুড়ে সংস্থা গজিয়ে ওঠে অনেক সময়েই। এমন সব সংস্থা, যাদের নামই কখনও শোনা যায়নি। এমনও দেখা গিয়েছে যে, শুধুমাত্র স্বাস্থ্য দফতরে ওষুধ সরবরাহ করবে বলেই একাধিক সংস্থার জন্ম হয়েছে। এমনও ঘটেছে, টেন্ডারে ন্যূনতম তিনটি সংস্থাকে অংশ নিতে হবে এমন নিয়ম থাকায় দু’টি ‘ভুতুড়ে’ সংস্থা অংশ নিয়েছে, যাতে তৃতীয় সংস্থাটি অনায়াসে বরাত পেয়ে যায়। এগুলো নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি।”
যার ফল, সরকার কোটি কোটি টাকা খরচের পরেও নানা হাসপাতালে সরবরাহ হয়েছে নিম্নমানের ওষুধ, যাতে অসুখ তো সারেইনি, একাধিক ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার অভিযোগও উঠেছে। ঠিক মানের ওষুধের ফাঁকে অনায়াসে ঢুকে গিয়েছে নিম্নমানের ওষুধ, জাল ওষুধ। খেসারত দিতে হচ্ছে গরিব মানুষকে। এসএসকেএমের এক চিকিৎসক জানালেন, অস্ত্রোপচারের পরে এক রোগিণীকে যে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছিল, তা তাঁর মলের সঙ্গে আস্ত বেরিয়ে যাচ্ছিল। কথাটা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। পরের দিন আয়া তাঁকে দেখান, মলের মধ্যে সেই ট্যাবলেট। বহু চেষ্টাতেও যে ওষুধ গলে যাওয়া তো দূর, হাতুড়ি মেরেও গুঁড়ো করা যায়নি। কী দিয়ে তৈরি সেই ওষুধ? উত্তর জানা নেই।
ওষুধ সংক্রান্ত বেশির ভাগ অভিযোগই স্বাস্থ্য ভবন পর্যন্ত পৌঁছয়। তার পরে কী হয়? স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের উত্তর, “যখনই কোনও অভিযোগ এসেছে, সেই ওষুধের পরীক্ষা করিয়েছি। প্রয়োজনে যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়েছি। ওষুধের পরীক্ষা হয় রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের ল্যাবরেটরিতে। এ ছাড়া, এনএবিএল স্বীকৃত কিছু ল্যাবরেটরির সাহায্য নিই আমরা। বছর খানেকের মধ্যে আমাদের নিজস্ব, অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি তৈরি হতে চলেছে। স্যালাইন বা ওষুধ নিয়ে যে সব অভিযোগ এসেছে, আমরা তো পরীক্ষা করিয়েছি। সেই সব পরীক্ষার রিপোর্টে বেশির ভাগ সময়েই কিছু পাওয়া যায়নি। তা হলে আর কী করণীয় থাকতে পারে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy