ছোট্ট নাতির হাত ধরে বিচারের আশায় কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ সত্তরোর্ধ্ব দাদু।
কথা দিয়েও কথা রাখেননি ছেলের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর সরকারি চাকরি পেয়ে বাড়ি ছেড়েছেন তিনি। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল করা তো দূরঅস্ত্, সৎ ছেলের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার দায়িত্বও নেননি বলে অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে অর্থাভাবে এখন দু’বেলা দু’মুঠো ভাতও পাতে পড়ে না ওই মহিলার মৃত স্বামীর পরিবারে। মাধ্যমিকে ভাল ফল করা সত্ত্বেও বাবা-মা হারা ছোট্ট ছেলেটার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এমতাবস্থায় ছোট্ট নাতির হাত ধরে বিচারের আশায় কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ সত্তরোর্ধ্ব দাদু। বুধবার সেই মামলায় অভিযুক্ত সৎ মায়ের বেতন বন্ধের নির্দেশ দিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। পাশাপাশি তাঁর নির্দেশ, আগামী শুনানিতে সৎ মাকে হাজিরা দিতে হবে আদালতে।
গত বছর হাই কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন পূর্ব মেদিনীপুরের ছত্রীর বাসিন্দা ৭৭ বছর বয়সি দয়ানন্দ টিঙ্গুয়া। পড়াশোনা বেশি দূর করেননি। হিতৈষীরা তাঁকে পরামর্শ দেন, এক মাত্র উচ্চ আদালতে গেলেই বিচার পাবেন। তা শুনেই বছর ষোলোর নাতি সমীর টিঙ্গুয়াকে সঙ্গে নিয়ে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন দয়ানন্দ। সেই মামলা ওঠে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে।
দয়ানন্দ আদালতে জানান, বছর ছয়েক আগে পাঁশকুড়ার একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি (গ্রুপ ডি)-র পদে কর্মরত অবস্থায় তাঁর ছেলের ‘রহস্যজনক’ ভাবে মৃত্যু হয়। নিয়ম মেনে ছেলের মৃত্যুর পর তাঁর সেই চাকরি পান দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিঙ্কিরানি টিঙ্গুয়া। শর্ত ছিল, স্বামীর গোটা পরিবারের দেখভাল করবেন তিনি। সেই শর্ত মেনেই চাকরিতে ঢোকেন পিঙ্কি। কিন্তু কিছু দিন পরেই বাড়ি ছেড়ে চলে যান তিনি। এখন দয়ানন্দদের প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। দিনে দু’বেলা ভাত জোটে না। মাথায় ছাদ নেই। ত্রিপল টাঙিয়ে কোনও মতে থাকেন তাঁরা। আদালতে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি।
দয়ানন্দের আইনজীবী সুপ্রিয় চট্টোপাধ্যায় আদালতে বলেন, ‘‘দেড় বছর বয়সে নিজের মাকে হারায় সমীর। তার পর থেকে বাবাই দেখভাল করতেন। কিন্তু কাজের চাপে সন্তানের দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছিল না বলেই ২০১২ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। যাতে সমীরের স্বাভাবিক জীবনে, তার লেখাপড়ায় বাধাবিপত্তি না আসে। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটাই ঘটল।’’
দয়ানন্দ ও তাঁর আইনজীবীর মুখে গোটা ঘটনা শুনে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, সমীরের লেখাপড়ার জন্য পিঙ্কিকে তাঁর বেতনের নির্দিষ্ট অংশ, হিসাব অনুযায়ী মাসিক সাত হাজার টাকা দিতে হবে। পাশাপাশি, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনকে সমীরদের জন্য এক বাড়ি বানিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দেন তিনি।
গত বছর ডিসেম্বরে আদালতের এই নির্দেশে দয়ানন্দের সংসারে সাময়িক ভাবে সমস্যার সমাধান হলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বুধবার আবার ছোট্ট নাতিকে নিয়ে আদালতে হাজির হয়ে দয়ানন্দের অভিযোগ, আদালতের নির্দেশের পর মাত্র তিন মাস সাত হাজার টাকা করে দিয়েছেন পিঙ্কি। গত এপ্রিল থেকে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দয়ানন্দের আইনজীবী জানান, সমীর মাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে। ৮৮ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। কিন্তু টাকার অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছে না সে।
এ কথা শুনে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, ‘‘আমি নির্দেশ দেওয়ার পরেও টাকা দেওয়া হচ্ছে না!’’ এর পরেই রাজ্য সরকারকে পিঙ্কির বেতন বন্ধের নির্দেশ দেন তিনি। পিঙ্কিকে আগামী ৩০ অগস্ট আদালতে হাজির হওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। পিঙ্কির হাজিরা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারকে। পিঙ্কির আইনজীবী অবশ্য আদালতে জানান, ছেলের টাকা বন্ধ করার ব্যাপারে মক্কেলের কাছ থেকে কিছু জানতে পারেননি তিনি। তাঁর সঙ্গে অনেক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।
ঘটনাচক্রে, এই মামলা চলাকালীন বিচারপতির এজলাসে হাজির ছিলেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। নির্দেশ দেওয়ার পরেই বিকাশের উদ্দেশে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন করেন, ‘‘আমি কি ভুল নির্দেশ দিলাম?’’ উত্তরে বিকাশকে বলতে শোনা যায়, ‘‘না, না। আপনি কোনও ভুল নির্দেশ দেননি। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের তুলে আনাই আমাদের কাজ। এটা আদালতের কর্তব্য। বার অ্যাসোসিয়েশনের এক জন সদস্য হিসাবে এই নির্দেশে আমি গর্ববোধ করছি।’’ সমীরের লেখাপড়া, থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছিল জেলা শিশু সুরক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে। তারাও বুধবারের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy